প্রথম পাতা » মতামত » রুচির দুর্ভিক্ষ

রুচির দুর্ভিক্ষ

Mamunur Rashid

নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ একটা শব্দবোমা মেরে দিয়েছেন পুরো জাতির ওপর। ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ বলে তিনি যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তা রীতিমতো ভয়াবহ। এ দেশে মামুনুর রশীদের বন্ধু খুব বেশি নেই। এমনিতেই লোকটি নাটুকে। তারপরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী স্বাধীনতাপ্রিয় একজন মানুষ। দীর্ঘসময় নাটকের সাথে যুক্ত ছিলাম। তাই লোকটিকে আমরা ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। সুতরাং নিম্নরুচির উত্থানে তিনি যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। উদাহরণ স্বরূপ তিনি যে ব্যক্তিটির কথা বলেছেন তাকে এ জাতির বহু মানুষ দেখে আত্মপ্রত্যয়ের একজন মহান আদর্শরূপে! এটি আরো ভয়াবহ। লোকটি সিনেমায়, গানে, বিভিন্ন বিষয়ে যে রুচির চর্চা করছেন তা বর্তমান ও ভবিষ্যত বাংলার জন্য চূড়ান্তরকম অমানিশার সৃষ্টি করছে। তার কুরচিপূর্ণ সংলাপ, অ্যাকশন, অ্যাক্টিং, কাহিনি বাংলা সিনেমার তেইশ মেরে দিয়েছে বহু আগে। দুর্ভিক্ষে নিপতিত একশ্রেণির ভাইলোক তাকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে রাজনীতিতে, সংস্কৃতিতে। বাংলার রাজনীতি কী ভয়ঙ্কররূপে দেউলিয়া হয়েছে যে তাকে একাই দুটি আসনে নির্বাচন করতে হয়! আবার তাকে হারাতেও রাতভর একদল লোকের জেগে থাকতে হয়! এখানে রাজনীতির দুর্ভিক্ষটিও ভাববার বিষয় বৈকি। সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিতে তার বড়জোর একজন কর্মী সমর্থক থাকার কথা। বিদ্যায় বুদ্ধিতে লোকটির নির্বাচনি মাঠে একেবারে পার্লামেন্ট মেম্বার হওয়ার মতো দুর্ভিক্ষ এ জাতির জন্য কলঙ্কের অধ্যায়। বাঙালির ভোটের মাঠে রুচিশীলতার প্রশ্ন আমার বহুদিনের। কারণ এ মাটিতে কাজী নজরুল, নির্মলেন্দু গুণ ভোটে দাঁড়িয়ে জামানত হারিয়েছেন!

বাঙালি সংস্কৃতিকে সুসংহত করেছেন আমাদের মহান রাজনীতিবিদরা, সাহিত্যিকরা, বুদ্ধিজীবীরা। আমাদের কবিরা কৃষকের সাথে নিজেদের রূপকায়িত করেছেন। নিম্নবিত্তের প্রান্তিক মানুষকেও সাহিত্যের বিশাল সভায় স্থান দিতে বলেছেন। তবে রুচিহীন অকবিকে নয়। যারা মামুনুর রশীদের সমালোচনায় নেমেছেন তারা আমাদের চিরপরিচিত। এদেশের স্বাধীনতাকে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তেল-নুন-লাকড়ির দামে যারা মুক্তিযুদ্ধকে মূল্যায়ন করে তারাই অপুরুষের মাঝেও দেখে আত্মশক্তির মহাক্রম। নিজেদের দীনতা, ব্যর্থতাকে ঢাকার একটি কৌশল ছাড়া এ আর কিছু নয়। আজ মামুনুর রশীদের সমালোচকরাই কাল ইনিয়ে বিনিয়ে বলবে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল কি না। এরাই মেট্টোরেলে চড়ে শশব্দে গলা পরিষ্কার করে পথচারীর ওপর। হাসপাতালের বেসিনে বেসিনে পানের পিকে রক্তলাল অবস্থার জন্য দায়ী আত্মপ্রত্যয়ী রুচিহীন মানুষটি! মেরিন ড্রাইভে উৎকট গন্ধ পাচ্ছেন? অন্যের আত্মশক্তিতে বলীয়ান ভাইটি একটু আগেই সেখানে পেট পরিষ্কার করে এসেছে। পদ্মাসেতুর পিলারে নায়িকার নাম, টানেলের বাঙ্কারে ভাবীর ফোন নম্বর, বাসের সিটের পেছনে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য আপনার চোখকে ধাঁধিয়ে দেবে। রুচিহীন এই মানুষগুলোকে আপনি নিজের পরিচয়ে বলবেন পিএইচডিধারী হিসেবে। সে বলবে বয়া থাকেন টিপ মাইরা। যদি বলেন থানার এএএএএসআই। আব্বা বলে হাত ধরার চেষ্টা নিবে। আপনি কোথাও রুচিশীল মানুষ পাবেন না। দশ মিনিট কথা বলার নিয়তে এগিয়ে যান। দুই মিনিটের মাথায় আপনার মোহভঙ্গ হবে। কথা চালিয়ে যেতে পারবেন না। নিজেকে মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে!

রুচিহীন জাতির জন্য সুরম্য কোনোকিছুই টেকসই হয় না। ‘প্রফুল্লকমলে কীটবাস’-রূপে সবকিছুই বিষণ্ন মনে হয়। আমাদের রুচির চর্চা দরকার। যে রুচির পরিচয় পেয়েছি লালন-মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-শহীদুল্লাহ-নজরুল-জয়নুল-মুনীর চৌধুরীদের কাছ থেকে, যে রুচির চর্চা করেছেন ভাসানী-বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনরা, যে সংহত জীবনের কথা বলেছেন মোতাহার-আবুল ফজল-আবদুল কাদিররা আমরা তাদেরই উত্তরাধিকার।

এ জাতির প্রকৃত হিরোর অভাব নেই। তথাকথিত হিরোর মাঝে আত্মপ্রত্যয় খোঁজার মতো ‘ভাড়েও ভবনী’ আমরা নই। আমাদের রুচির জয় হোক। শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *