প্রথম পাতা » মতামত » আমি ক্লান্ত প্রাণ এক…

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক…

Sheikh Hasina

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই ছবিটি গতকাল থেকে ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। ছবিটি একনজর দেখার পরই আমার জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার একটি লাইন মনে পড়লো- ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক…!’ কিন্তু এই কবিতার পরের আর কোনো লাইনের সাথে এই ছবিটার মিল নেই, মিল আছে কেবল একটি শব্দে। সেই শব্দটি দিয়েই এ লেখাটি শেষ করবো।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চারিদিকে জীবনের সফেন আমি দেখিনি। বরং তাঁর চতুর্দিকে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ আছে যা তাঁকে প্রায়ই করে তুলেছে ক্ষত-বিক্ষত। এই ছবিটা একাধারে ক্লান্তি, অবসাদ, ক্লেদ আর একাকিত্বের স্মারক।

পরিবারের সবাইকে হারিয়ে একটি ছন্নধারা জীবনে চরম হতাশা, নানা প্রতিকূলতা, সংশয়াচ্ছন্ন জীবন নিয়েও তিনি বাংলায় ফিরে এসেছিলেন আশির দশকে, বাংলার ‘ঈশ্বরী পাটনি’ হয়ে। নিজের জীবনের কথা না ভেবে বাংলার মানুষকে ভালোবেসে সেদিন হাতে তুলে নিয়েছিলেন নৌকার বৈঠা। বাঙালির সুখ দুঃখের সারথি হয়ে নেমেছিলেন রাজপথে, গ্রামের মেঠোপথে, ক্ষেতের আইল ধরে, জল-জোছনার মায়াময় পথ বেয়ে ঘুরেছিলেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। পনের বছরের সংগ্রাম শেষে প্রথমবার তিনি প্রধানমন্ত্রী হোন ১৯৯৬ সালে। কিছু ভুল, কিছু ফুল, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সফলতার মধ্য দিয়ে শেষ হয় তাঁর প্রথম সরকারের মেয়াদ। সবুজ পাহাড়ের ভিতর দিয়ে হিংসার যে স্রোত বইছিল তা তিনি বিচক্ষণতা ও কৌশলে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন। সেই শান্তির ছায়াতলে পাহাড়ি-সমতলবাসী এক বৃন্তে পাশাপাশি আছে আজো। পৃথিবীর ঘৃণ্যতম যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে তা নানাদিক থেকে কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাকেও হার মানায়। একরাতে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে এমন নিঃস্ব পৃথিবীর আর কোন রাষ্ট্রনায়কের কপালে জুটেছিল? পিতৃহত্যার চরম প্রতিশোধটা নিতে হয়েছিল কৌশলে, প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানকে বিবেচনায় রাখাটাও ছিল অন্যতম চ্যালেঞ্জ। অবশেষে ২য় বারে ক্ষমতায় এসে জঘন্য হত্যাকাণ্ডটির বিচার তিনি বাংলার মাটিতেই করেছেন। শেখের বেটি সেদিন আন্তর্জাতিক সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন পিতৃহত্যার প্রতিশোধ কীভাবে নিতে হয়। কীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হয় ন্যায়বিচার।

তারপর অনেক জল গড়িয়েছে বুড়িগঙ্গায়। নানা ঘাত প্রতিঘাত, জেল জুলুম সহ্য করেছেন, পালিয়ে যাননি দেশছেড়ে । বাংলার মানুষ তাঁকে ভালোবেসে আবারো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের আসনে বসিয়েছে তাদের প্রিয় নেত্রীকে, বাঙালির দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। ২০০৮ থেকে ২০২৩! দীর্ঘ পনের বছর ধরে তিনি বাংলার মানুষের আস্থার প্রতীক, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রতীক হয়ে কাজ করছেন নিরন্তর। দেশ আজ অনেক সূচকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ।

বঙ্গবন্ধু একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন বাইরে থেকে তিনি যা আনেন ‘চাটারদল’ সব খেয়ে ফেলে। চাটারদল এখন নেই। কিন্তু ‘কামড়াইনারদল’ আছে। চাটাচটির সময় নাই। সময় এখন বর্ষাকাল! বিড়াল খামচায় বাঘের গাল! মরণকামড় চলছে সব জায়গায়।

সিরাজউদ্দৌলা পলাশির শিবিরে যুদ্ধের সমস্ত আয়োজন তদারকি করে আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন প্রিয় মোহনলালকে : ‘কতবড় শক্তি, তবু কত তুচ্ছ!’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে মানুষের অভাব নেই। তবে দেশপ্রেমিকের খুব অভাব। তাই তিনি নিয়ত একা। পনের বছরে দেশের নানামাত্রিক উন্নয়ন নিশ্চয়ই আপনার চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। তারপরও কিছু বিষয়ে সংশয়, সন্দেহ, ব্যর্থতা তো আছেই। সবচেয়ে বড় আঘাতটা এসেছে শিক্ষায়। করোনার ভয়াবহ গ্রাস এরজন্য অনেকটা দায়ী। দায়ী এদেশের প্রতিটা পরিবার, প্রতিটা অভিভাবক। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের অনেক ভোগাবে আজকের জেনারেশন। কোয়ালিটি এডুকেশন না হলে বিশ্বে টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের দরকার ইনোভেশন, নতুন চিন্তা, নতুন ভাবনা। ভালোকিছুর জন্য অপেক্ষা করে আছি।

দেশে ভয়াবহ লোড শেডিং চলছে। সেজন্য অনেক কারণ আছে। তবু এ সময়ে পায়রা কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়াটা মোটেই সুখকর কোনো বিষয় নয়। নতুন আরেকটি চালু হতে কত সময় লাগবে সেটিও ভিন্ন দুশ্চিন্তার কারণ। এমন একটি আবহে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ ছবিটি অনেক কথা বলে দেয়। যিনি পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের সংবাদটি দিলেন তাঁকে হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ সংবাদটির জন্য দায়িত্ব দেননি। তিনি আশা নিয়ে হয়তো অপেক্ষা করবেন। দেশে চরম বিদ্যুৎ বিপর্যয় চলছে। এজন্য দায়িত্বশীল লোকজনের সাথে আমরাও কম দায়ী নই। গতকালকের আমার লেখা ‘ঘোড়ারোগ’ – এ কিছু কথা এ বিষয়ে লিখেছিলাম।

পুরো পৃথিবীতে বঙ্গবন্ধুকন্যার একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। এদেশের একটি অংশ মনে করে বিশ্বনেতা মানে ইমরান খান, এরদোয়ান! অথচ উল্লিখিত দুজনেই নিজদেশেও বিতর্কিত। একজন আদালতে ঘুরছেন। আরেকজন ক্ষমতায় এলেন একই নির্বাচনে দ্বিতীয়বার ভোটের মাধ্যমে। শেখ হাসিনা তাঁর ন্যায়নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতায়, একটি অনুন্নত দেশকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে রূপান্তর করে পৃথিবীতে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তিনি বিশ্বনেতা হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। চোখে যাদের হিংসার ধূলা তারা ধলা জিনিস দেখে না। পৃথিবীর নারীনেতৃত্বের আইডল আমাদের দেশরত্ন, আমাদের জননেত্রী।

তারপরও তিনি একা। তিনি রাবণের মতো একা। এতো শক্তি, এতে সামর্থ্য থাকার পরও রাবণ যেমন পারেনি লঙ্কার সর্বনাশ ঠেকাতে, মেঘনাদ যেমন অকালে হারিয়ে গেলো বিভীষণের শঠতায় তেমনি একজন শেখ হাসিনাও নিয়তির বরকন্যা। জানি না তাঁর ভাগ্যে কী আছে? যদিও তাঁর হারানোর কিছু নেই। আর কী হারাবেন তিনি ?

তবে তাঁকে হারালে বাঙালি অনেক কিছু হারাবে। ‘বনলতা সেন’ কবিতার শেষে অন্ধকারের কথা আছে। বাংলার ভাগ্যাকাশেও কি ‘থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার’ অবস্থা বিরাজ করছে?

আপনার প্রতি আজো আস্থা আছে তাদের, যাদের হৃদয়ে প্রেম আছে, করুণার আলোড়ন আছে। আপনি দীর্ঘজীবী হোন, মাননীয় দেশরত্ন।

জয় বাংলা

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *