শিরোনাম দেখে ভিড়মি খাবেন না। ভাববেন না যে আমি মরে গেছি কিংবা রাধার স্বামী আয়ান ঘোষ হয়ে গেছি ! আমি বহাল তবিয়তে আছি। আছিরে ভাই আছি ! আমি আসলে কী পারি না তা জানতে হলে পুরোটা পড়ে নিতে হবে। বিবিকে দেখলাম সেদিন তেঁতুল কিনছে ! সুতরাং সন্দেহ দূর কী বাত!
আমার নাট্যদল ‘থিয়েটার মহলা’ একবার ‘চোরা’ নামের এক নাটক নামালো। আশ্চর্য হই, আজ প্রায় বিশ বছর আগের নাটকটিতে আশ্চর্য বিষয় এনেছিলেন গুরু এমএবি সুজন। নাটকটি তখন তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। একালেও নাটকটি ভয়াবহ রকম প্রাসঙ্গিক। নাটকটির সব ডায়লগ আমার মুখস্থ। এতে অভিনয় করেছিলেন দুলাল ভাই, আছমত কাকা, নাট্যকার এমএবি সুজন ভাই, কামাল ভাই, শাহিন ভাই প্রমুখ। সবাই খুব দুর্দান্ত অভিনয় করতেন। একজন চোর কী করে রাজনীতির মাঠে সমাজকল্যাণ সম্পাদক হয়ে উঠলো এবং চোরের পরিবর্তে শাস্তি হলো দারোয়ানের তারই শিল্পরূপ দিয়েছিলেন সুজন ভাই। নাটকে ছাগল নিয়ে একটি সংলাপ ছিল এরকম:
‘একবার লঞ্চ ডুবিতে পেঁচি বাড়ির ফজার বেটা জহু গেলো মইরা। লাশ খুঁইজা পাইলো না। তখন মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা দিল -যাদের পরিবারের লোক মারা গেছে তাদের সমবেদনা জানাই। আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা সরকারের তরফ থিকা একেকটি লাশের বদলে একেকটি করে ছাগল উপহার দিব, এনশাল্লাহ! সরকার খুব দয়াবান। নাই মার চেয়ে কানা মা-ও যে ভালো সরকার এটা খুব ভালো বুঝে। পোলার শোকে কাতর ফজা বুকে পাত্থর বাইন্দা আশায় রইল। এক বছর পর ফজার কপাল খুললো! সরকার ফজারে একটা বেলাক বেঙ্গল টাইগার মানে ছ আকার ছা, গ ল ছাগলের ছাও দিল…!’
নাটকের এ সংলাপটি কিন্তু বানানো না। একবার ভয়াবহ লঞ্চডুবির পর নৌমন্ত্রী মহোদয় এ ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন মন্ত্রিবর্গের একটা যুগ ছিল বটে। মাঝে মাঝেই উদ্ভট কথা বলতেন কেউ কেউ। ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ…’ এমন অনেক সংলাপ জাতির মুখে মুখে শোভা পেতো। সত্যি – আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা !
ছাগলকাণ্ড এদেশে নতুন কিছু না। কোরবানির ইদে ভয়াবহ ছাগলকাণ্ড হয়ে গেলো ! দেশে অজস্র ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস চোরের আমদানি হয়েছে ! গত পনের বছর দেশে কী পরিমাণ ছাগলের চাষ বাম্পার হলে একটির দাম পনের লক্ষ হতে পারে একবার ভাবেন তো ! আমরা বোকাসোদা নিম্নবিত্তরা কী করলাম ! পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা গরু কোরবানি দিতে গিয়ে চারজনের শেয়ার খুঁজি। আমি দেশের একজন প্রথম শ্রেণির গেজেটেড চাকরিজীবী ! একটিমাত্র গরু ৭৩০০০/ টাকায় কোরবানি দিতে গিয়ে ত্রাহি অবস্থা! অথচ কুন্তলের বয়সী এক পোলা নাকি কোরবানি দেয় ৭০ লক্ষ টাকার গরু আর পনের লক্ষ টাকার একটি ছাগল ! তার কোটি টাকার কয়েকটি গাড়ি, বাড়ি, পার্ক, ফ্ল্যাট ইত্যাদি ইত্যাদি। মতিউর রহমানরা এদেশের তেইশ মেরে দিয়েছে। হাজার হাজার মতিউররা আজ চারপাশে। আমি কোন মতিউরের কথা লিখবো? আজ পেপারে পড়লাম কয়েকজন মিলে ন্যাশনাল ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে ! মির্জা গালিবের মতো বলতে হয় :
‘মাননীয় রানি,
আমরা আর কতোটা বিপর্যস্ত হয়ে আপনার কাছে
আর কতোবার ফরিয়াদ জানাবো? আপনি আর কতোবার সব শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলবেন
‘বলেন কী? তাই নাকি?’
কতিপয় শুয়োরের বাচ্চা গত দশকে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এদের পোলাপানদের আলিশান বাড়ি, বিদেশি গাড়ি দিয়েছে। অফুরন্ত টাকা দিয়েছে। আমোদের জীবন দিয়েছে। বিদেশে বাড়ি করেছে, বাসিন্দা বানিয়েছে। এরা সব করেছে আমার আপনার টাকা লুটপাট করে। আমার সন্তানেরা পড়ে ভাঙা স্কুলে, ফ্যান ঘুরে না, লাইট জ্বলে না, টয়লেটে যাওয়া যায় না। ভ্যাপসা গরমে এরা হাঁশপাশ করে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। শিক্ষার উপকরণ কেনার সামর্থ্য নেই অনেকের। প্রতিদিন সিলেবাস চেঞ্জ হয়। পরীক্ষা পদ্ধতি ও মূল্যায়ন পরিবর্তন হয় নিয়মিত। আমার সন্তানেরা এ জাতির গিনিপিগ !
পুরো দেশটা গিলে খাচ্ছে গুটিকয়েক দুর্বৃত্ত। বাঙালি কেবল জানে কোকাকোলা বয়কট করতে ! এ দেশে সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ বেতন ৭৮ হাজার টাকা ! একজন লোক যদি একাই একটি মসজিদ করে দেয় আপনারা কেন প্রশ্ন করেন না এই টাকা সে কোথায় পেয়েছে? আপনারা কেন তার গরুর মাংস সমাজে বন্টন করেন যার চাকরি ১৬ হাজার টাকার স্কেলের অথচ সে তিন লক্ষ টাকার কোরবানি দেয়? একবারও কি তাকে বয়কট করেছেন যে সুদের ব্যবসার সাথে জড়িত? একবারও কি বলেছেন তার কোনো অনুদান মাদ্রাসায় নিবো না যার টাকায় হারামের সংস্রব আছে? এই আমরা আপনারাই তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছি। আজ পুরো জাতি বুঝে গেছে চিত্তের চেয়ে বিত্ত বড়। আজ সব ফেল মেরেছে। রবীন্দ্র-নজরুল-লালন দর্শন, ইনসাফ, সাম্যবাদ, মানবতাবাদ সব আজ ব্যর্থ ! আজ টাকা যার, পৃথিবী তার ! প্রান্তিক মানুষরা আজ এই পৃথিবীর ভিক্ষুক মুসাফির ছাড়া কিছুই না। এই দেশটা আসলে মতিউর আর তার ছেলেদের। উচ্চবংশীয় গরু আর ছাগলদের ! আমার মতো মানুষের মূল্য আজ ছাগলের একটা পায়ের খুড়ের চেয়েও কম!
হালকা কিছু লিখবো ভেবেছিলাম। কিন্তু না। আমার সন্তানদের ভয়াবহ ভবিষ্যত নিয়ে আমি সত্যই চিন্তিত। ওরা এদেশে টিকবে না। এদেশ ছেড়ে ওদের পালাতে হবে একদিন ।
কিন্তু কোথায় যাবে আমার সন্তানেরা? কেন যাবে তারা?
চোরাকাহিনি শুরু হয়েছে। তবে এটি বেশিদূর যাবে বলে মনে হয় না। চোরে চোরে গাঁথা, এক চোরে ধরা খাইলে সব চোরের ব্যথা !