কিছুদিন যাবত হুমায়ূন আহমেদের দুটি উপন্যাস তৃতীয়বারের মতো পড়ছি। এর একটি ‘মধ্যাহ্ন’ (২০০৮), অন্যটি ‘বাদশাহ নামদার’ (২০১১)। ‘মধ্যাহ্ন’ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই প্রথম পড়েছি। পরে আরো একবার পুরোটা পড়েছিলাম। উপন্যাসটি পড়ি আর উপলব্ধি করি আমাদের প্রাচীন বাংলা, মধ্যযুগের জীবনগুলো কী ভয়ানক বিনষ্টির সমষ্টি। আমাদের পূর্বপুরুষরা চাইলে জ্ঞান বিজ্ঞানে কতোটাই না সমৃদ্ধ করতে পারতেন এই বাংলা অঞ্চলকে। ব্রিটিশরা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করলো একাদশ শতকের শেষদিকে। তারপর তারা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রসদ সংগ্রহ করে অক্সফোর্ডকে তারা গড়ে তুলেছে। আজ পৃথিবীব্যাপী এর সাড়া পড়েছে। ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসের এক জমিদার শশাঙ্ক পাল নতুন যৌবন লাভের আশায় সমস্ত বিক্রি করে আজব এক মৎস্যকন্যার এক পিস মাংস কিনে নিয়েছে ১০ হাজার টাকায়! এক টাকায় তখন আটমন চাল পাওয়া যেতো! অর্থের কী নিদারুণ অপচয়! নিজেদের ভোগবিলাসে মত্ত এসব সামন্তশ্রেণির লোকজন দু হাতে অর্থের অপচয় করে গেছেন। চাষ করেছেন ঘৃণা, সাম্প্রদায়িকতার আর হিংসার। ফলে প্রাচীন বাংলার এতো ঐশ্বর্য থাকার পরও এটি হতে পারেনি শিক্ষাদীক্ষার কোনো সূতিকাগার। এখানে যৌবনকে ভোগ করার জন্যই সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে। আজো এভাবেই চলছে বৈকি! এ অঞ্চলের সিনেমায় আজো নায়ক মরে গেলে ছবি ফ্লপ করে। এখানে প্রেম মানে ‘হাম, তুম, পেয়ার, দিল!’
এই সমস্যা শুধু বাংলার নয়। উপমহাদেশ জুড়েই এ সংকট তীব্র। মুঘলরা উপমহাদেশ শাসন করেছে কয়কশ বছর। ১৫২৬ এ বাবর যে ভিত্তি গড়েছিলেন তা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ পর্যন্ত এসে স্তিমিত হয়ে পড়েছে। মাঝে যুদ্ধ, আয়েশী জীবন, ভাই-ভাই বিদ্রোহ, পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব নানাভাবে ফুরিয়ে গেছে জীবন। কোনো কোনো সম্রাটের বেলায় সত্য হয়েছে এই শের :
‘সম্রাটের বন্ধু তার সুতীক্ষ্ণ তরবারি
এবং তার ছুটন্ত ঘোড়া আর তার বলিষ্ঠ দুই বাহু
তার বন্ধু নিজের বিচার
এবং পঞ্জরের অস্থির নিচের কম্পমান হৃদয়!’
সম্রাটের কোনো পুত্র থাকে না। কন্যা থাকে না। স্ত্রী থাকে না। আত্মীয় পরিজন থাকে না। সম্রাটের থাকে কেবল তরবারি! সম্রাটের চারপাশে অবিশ্বাস, সন্দেহের ঘোর অমানিশা। রাজা যায়, রাজা আসে। আবার পুরাতন অবিশ্বাসে ভরে ওঠে খাসমহল, আমমহল। হেরেমখানায় শতাধিক নারীসঙ্গ, ভোগবিলাসে মত্ত বাদশাহ! খাসমহলে শত শত পুরুষকে খোজা করে রাখা হতো (অপারেশনের মাধ্যমে পুরুষত্ব নষ্ট করা)। কানে গরম সিসা ঢেলে বধির করা হতো সুস্থ মানুষদের। সবই করা হতো রাজত্বের সংশয় দূর করার জন্য, শাসনকার্য নির্বিঘ্ন করার জন্য। অপরাধীর শাস্তির রূপ ছিল ভয়ানক। হাতির পায়ে পিষ্ট করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ছিল বহুল প্রচলিত একটি শাস্তি। পাথর মেরে হত্যা, গায়ে মৃত পশুর চামড়া জড়িয়ে পিচঢালা পথে ঘোড়দৌড়ের মাধ্যমে হত্যা এমন ভয়ঙ্কর শাস্তির বিধান তো হরহামেশাই হতো। সব শাস্তি কি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত অপরাধীকে দেওয়া হতো? না, যদি তাই হতো তবে মুঘলদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর বৈরামখানের মৃত্যু হতো না আকবরের পাঠানো গুপ্তঘাতকদের হাতে ! যে আকবরকে ‘দ্য গ্রেট’ বানিয়েছিলেন বৈরামখান তাকেই প্রাণ দিতে হয়েছে সন্দেহের বিষবাষ্পে!
মধ্যযুগের বাংলার এক বিদ্রোহী শাসক শেরশাহকে শায়েস্তা করতে সম্রাট হুমায়ুন বাংলায় আসেন ১৫৩৭ সালে। যুদ্ধযাত্রায় হাতির সংখ্যা ছিল মাত্র আটশ ! যাত্রাপথে হুমায়ুনের খাদ্যতালিকা নিম্নরূপ :
পোলাও : পাঁচ ধরনের
রুটি : সাত প্রকারের
পাখির মাংস : কিসমিসের রসে ভেজানো পাখি ঘিতে ভেজে দেওয়া
পাখিদের মধ্যে ছিল হরিয়াল, বনমোরগ, বিশেষ শ্রেণীর ময়ূর
ভেড়ার মাংস : আস্ত ভেড়ার রোস্ট
পাহাড়ি ছাগের মাংস : আস্ত রোস্ট
ফল, শরবত, মিষ্টান্ন।
যুদ্ধকালীন হুমায়ুন ও তাঁর পরিবারের জন্য বাবুর্চির সংখ্যা ছিল এক হাজার! যাত্রার সময় রসদখানায় মহিষের দুধের ঘি ছিল দশ মণ, গরুর দুধের ঘি ত্রিশ মণ!
পুরো মুঘল সাম্রাজ্য গেছে কোহিনূর ও ময়ূর সিংহাসন দখলের ইতিবৃত্তে! একটি পাথর ও একটি সিংহাসনের লড়াইয়ের নিচে চাপা পড়েছে লক্ষ লক্ষ সৈনিকের প্রাণ।
সম্রাট সাজাহান তৎকালীন বিশ কোটি টাকা ব্যয়ে, বিশ হাজার শ্রমিক দিয়ে বাইশ বছরে নির্মাণ করিয়েছেন তাঁর প্রেমের তাজমহল! যমুনা নদীর তীরের এই সমাধিস্থলে লাখ লাখ পর্যটক সেখানে প্রতিবছর ভ্রমণ করে এবং তারা প্রাক্তনের স্মৃতি হাতড়ে খিচ মেরে পড়ে থাকে! এছাড়া এই মহান স্থাপত্যটি পৃথিবীর মানুষকে কিছুই দিতে পারে নি।
সাজাহান এই মনুমেন্টের কাজ শুরু করেন ১৬৩২ সালে। এর চার বছর পর আমেরিকায় যাত্রা করে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ১৬৩৬ সালে! পৃথিবী বিখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে বিশ্বের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়! এই ভার্সিটি থেকে লাখ লাখ ইহুদি জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা করে বিশ্বকে লিড দিচ্ছে। আমরা আফগানি জোশে মত্ত আছি হালাল প্রেমিকা অন্বেষণে! এক ইহুদি জাকারবার্গ পুরো বাংলাদেশ নাচাচ্ছে। কাল ফেসবুক চিরতরে বন্ধ করলে কোটি কোটি বাঙালি মুসলমান নরনারী বুর্জ খলিফা থেকে লাফিয়ে একযোগে আত্মহত্যা করবে। কোকাকোলা বয়কট করে কয়দিন থাকবেন? ইজরায়েলকে থামাবেন সাবান আর সোডা কেনা থেকে বিরত থেকে?
আমাদের রোমান্টিকতা আমাদের বিপ্লবী-বিদ্রোহী-সৃষ্টিশীল করে তুলতে পারেনি। আমাদের করেছে ম্যারম্যরা পাংকু আবুল! প্রেমিকা একবেলা গাল ফুলিয়ে থাকলে আমরা আমগাছে দড়ি ঝুলাই। একটি গোলাপের জন্য প্রাণ দিয়ে দেই হামেশাই। আমরা প্রেমিক পুরুষ। হীরক রাজার দেশের প্রধান কণ্ঠস্বর ‘প্রিয়তমা’! আমাদের জাতিস্বর ‘রাজকুমার’! আমরা আত্মবিনাশী, আমাদের মুক্তি নেই।