প্রথম পাতা » সেরা » বিশ্বখ্যাত ভবঘুরে চার্লি চ্যাপলিন

বিশ্বখ্যাত ভবঘুরে চার্লি চ্যাপলিন

Charlie Chaplin

চ্যাপলিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি তাঁর শৈশবকেই বয়ে বেরিয়েছেন, যে শৈশব ছিল দুঃসহ। বাবা তাঁর মাকে ত্যাগ করেছিলেন। মা কখনো সস্তা নাটকের দলে গান গেয়ে, কখনো সেলাই করে চালিয়েছেন সংসার। তাঁরা না খেয়ে থেকেছেন বহু দিন। কখনো ভিক্ষা করে, কখনো চুরি করে জোগাড় করতে হয়েছে খাবার। শৈশবের সেই বঞ্চনা আর অপমানকেই যেন চ্যাপলিন মোকাবিলা করেছেন তাঁর চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে। চ্যাপলিন লিখেছেন, প্রবল বঞ্চনার ভেতর দাঁড়িয়েও কী করে পৃথিবীকে ভালোবাসতে হয়, সে শিক্ষা তিনি পেয়েছেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে।

চার্লি চ্যাপলিন (ঈযধৎষরব ঈযধঢ়ষরহ) নামেই বেশী পরিচিত স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র (ঝরৎ ঈযধৎষবং ঝঢ়বহপবৎ ঈযধঢ়ষরহ, ঔৎ.) একজন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র অভিনেতা। স্যার চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন ১৬ই এপ্রিল, ১৮৮৯ সালে ইষ্ট স্টি্রট, ওয়ালওয়ার্থর্, লন্ডনে জন্ম গ্রহণ করেন। হলিউড সিনেমার প্রথম থেকে মধ্যকালের বিখ্যাততম শিল্পীদের একজন চ্যাপলিন পৃথিবী বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকও বটে। চ্যাপলিনকে চলচ্চিত্রের পর্দায় শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতাদের একজন বলেও মনে করা হয়। চলচ্চিত্র শিল্প জগতে চ্যাপলিনের প্রভাব অনস্বীকার্য।

১৮৯১ সালের আদমসুমারী থেকে জানা যায় যে চার্লি তার মা হান্নাহ চ্যাপলিন এবং ভাই সিডনির সাথে ওয়ালওয়ার্থ, দক্ষিণ লন্ডনের বার্লো স্টি্রটে থাকতেন, এটি কেনিংটন জেলার অন্তর্গত। ইতিমধ্যে তার পিতা চার্লস চ্যাপলিন জুনিয়ারের সাথে তার মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে গেছে।

প্রকৃতি যেন নিজের জন্যই এই কাকতালীয় ঘটনাটির সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। যদি ক্যামেরা না হতো তাহলে পৃথিবীর ইতিহাসে চলচ্চিত্র বলে কোনো কিছুর উদ্ভব হতো না এবং চ্যাপলিনও পৃথিবীর মানুষকে হাসাতে পারতেন না। আবার যদি হিটলার পৃথিবীতে না জন্মাতো তাহলে চ্যাপলিন তার ছবির মাধ্যমে প্রতিবাদও জানাতে পারতেন না পৃথিবী বিখ্যাত ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরিচালক ও বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ স্যার চার্লস স্পেন্সর চ্যাপলিন।

চ্যাপলিনের শৈশব কাটে প্রচন্ড দারিদ্র আর কষ্টের মাঝে আর তাই হয়তো তিনি উপলদ্ধি করতেন দেওয়া ও পাওয়াতে কী আনন্দ। তিনি একটা কথা প্রায়ই বলতেন যে বৃষ্টিতে হাঁটা খুবই ভালো কারণ এই সময় কেউ তোমার চোখের অশ্রম্ন দেখতে পায় না। অত্যধিক দারিদ্রই চ্যাপলিনকে শিশু বয়সেই অভিনয়ের দিকে ঠেলে দেয়…তার মা-বাবা দুজনেই মঞ্চের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তাই এই পেশাতে আসাটাই তাঁর কাছে সহজ ছিল। চ্যাপলিন সেইসময়ের জনপ্রিয় লোকদল “জ্যাকসন্স এইট ল্যাঙ্কাসাফ্রার ল্যাডস” এর সদস্য হিসাবে নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৪ বছর বয়সে তিনি উইলিয়াম জিলেট অভিনিত শার্লক হোমস নাটকে কাগজওয়ালা বিলির চরিত্রে অভিনয় করেন। এই সুবাদে তিনি ব্রিটেনের নানা প্রদেশে ভ্রমণ করেন ও অভিনেতা হিসাবে তিনি যে খুবই সম্ভাবনাময় তা সবাইকে জানিয়ে দেন ।

একদিন চার্লি এমন একটা কাজ করে বসলেন যা তাঁর প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিল। সেটা ১৮৯৪ সালের কথা। মা গান গাইছেন। গান গাইতে গাইতে ক্রমেই তাঁর গলা বসে যেতে থাকে। এক সময় অবস্থা এমন হলো যে, তাঁর গলা থেকে আর কোনো শব্দই বের হলো না। দর্শকরা চিৎকার-চেঁচামেচি এবং হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দিল। বালক চ্যাপলিন স্টেজে পর্দার আড়াল থেকে সব তীক্ষè দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল। মা লিলি স্টেজ থেকে নেমে গেলে সে সোজা স্টেজে উঠে গান ধরল।

চার্লি ১৯১২ সালে প্রথম অভিনয় করেন। তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে আয় ছিল সপ্তাহে ১৫০ ডলার। আর ২ বছরের মধ্যেই এই আয় বেড়ে দাঁড়ায় সপ্তাহে ১২ দশমিক ৮৪৪ ডলার। চার্লির ছবিগুলো হলো- ‘দ্য গোল্ড রাশ’, ‘দ্য সাকাস’, ‘সিটি লাইট’, ‘মর্ডার্ন টাইমস’, ‘দ্য গ্রেড ডিরেক্টর’, ‘মসিয়ভেদু’, ‘লাইম লাইট’, ‘একিং ইন নিউইয়র্ক’ প্রভৃতি। চার্লি জীবনে অনেক ছবি করেছেন এবং দেশ-বিদেশে নানা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। জীবনে কৃতিত্বের জন্য রানী এলিজাবেথ কতৃক তিনি নাইট উপাধি লাভ করেন।

চ্যাপলিন অভিনীত মুখ্য চরিত্র তাঁর নিজের সৃষ্ট ভবঘুরে দ্য ট্রাম্প, ১৯১৪ সালে। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পর্তুগালে “শার্লট” নামে পরিচিত চ্যাপলিনের ট্রাম্প ভবঘুরে হলেও বিট্রিশ ভদ্রজনোচিত আদব—কায়দায় সুসংস্কৃত এবং সম্মানবোধে অটুট। শার্লটের পরনে চাপা কোট, সাইজে বড় প্যান্ট, বড় জুতো, মাথায় বাউলার হ্যাট, হাতে ছড়ি আর টুথব্রাশ গোঁফ। চ্যাপলিনের বর্ণময় ব্যক্তিজীবন তথা সমাজজীবন খ্যাতি-বিতর্ক দুইয়েরই নিম্ন থেকে শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছে গেছে।

চার্লির চমৎকার গলা শুনে দর্শকরা অবাক হয়ে যান। চিৎকার বন্ধ করেন এবং অতি শিগগিরই উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। সেদিন উপস্থিত সবাই এমনকি মা লিলিও চার্লির প্রতিভা দেখে অবাক হয়ে যান। মা অনুমান করেন, তাঁর ছেলে বড় হয়ে বিখ্যাত কেউ হবে। মার আশা চার্লি পূরণ করেছেন।

চার্লি চ্যাপলিন সম্পর্কে একটি মজার তথ্য

চার্লি চ্যাপলিন তখন পৃথিবী-বিখ্যাত। তার অনুকরনে অভিনয়ের একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হল। গোপনে চার্লি চ্যাপলিনও নাম দিলেন।প্রতিযোগিতাও হয়ে গেল। ১ম ও ২য় যারা হলেন তাদের নাম ঘোষনা করা হল। আর মজার কথা হল চার্লি চ্যাপলিন এখানে ৩য় হন।

চ্যাপলিন তথ্য

  • চার্লি চ্যাপলিনই প্রথম অভিনয়শিল্পী, যিনি টাইম সাময়িকীর প্রচ্ছদে জায়গা পেয়েছিলেন।
  • তাঁর বিখ্যাত চরিত্র ‘দি ট্র্যাম্প’কে ২৬ বছরে মোট ৭০টি ছবিতে দেখা গেছে। ২০১৪ সাল ট্র্যাম্পের ১০০ বছর পূর্তির বছর।
  • ছোটবেলায় একবার চ্যাপলিনের খুব অসুখ করেছিল। বিছানা থেকে ওঠার মতো শক্তি তাঁর ছিল না। তখন চ্যাপলিনের মা তাঁকে অভিনয় করে দেখাতেন, বাইরে কী কী ঘটছে। চার্লি চ্যাপলিনের ভাষ্য মতে, তাঁর কমেডি অভিনেতা হয়ে ওঠার পেছনে এই ঘটনার বড় অবদান আছে।
  • এন্টারটেইনমেন্ট উইকলির করা সর্বকালের সেরা তারকার তালিকায় তিনি নবম স্থানে আছেন।
  • চ্যাপলিনের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ক্রিস্টোফার চ্যাপলিন যখন জন্ম নেয়, তখন তাঁর বয়স ছিল ৭৩ বছর।
  • চ্যাপলিন প্রায় ৫০০ গানের কম্পোজার।
  • চ্যাপলিন অস্কার জিতেছিলেন অভিনেতা নয়, বরং কম্পোজার হিসেবে।

চ্যাপলিনের ৬৫ বছরের কর্মজীবনের যবনিকাপাত ৮৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুতে। ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বরে চার্লি প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান সুইজারল্যান্ডের কার্সিয়ারে। ওই দেশের ডিঙ্গিতে চার্লির শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এর পর ঘটে একটা দুর্ঘটনা। পরের বছর চার্লির মৃতদেহ চুরি হয়ে যায়। ১৬ দিন পরে তা উদ্ধার করে আবার সমাহিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুর এতদিন পরেও চার্লি এখনো গোটা বিশ্বে সমানে জনপ্রিয়। সবাই তাঁকে কৌতুক সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন।

পড়ুন: চার্লি চ্যাপলিন এর বাণী

সেরা থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

S M Mukul
এস এম মুকুল
লেখক-কলামিস্ট, হাওর ও কৃষি অর্থনীতি বিশ্লেষক

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *