প্রথম পাতা » মতামত » বাদশাহ নামদার হুমায়ূন

বাদশাহ নামদার হুমায়ূন

Humayun Ahmed

লেখালেখি করেও যে জীবনে বৈষয়িক সফলতা পাওয়া যায় এদেশে তার বড় উদাহরণ সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদ। বাষট্টি বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। তাঁর লেখালেখির শুরু সত্তরের দশকে হলেও দীর্ঘ বিরতির পর আবার নব্বই দশকের শুরুতে সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বছর তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেলেন সে বছরই তিনি ‘পড়াতে ভালো লাগে না’ বলে চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর তিনি শুরু করলেন পুরোপুরিভাবে সাহিত্যচর্চা। তাঁর উপন্যাসগুলো বিদগ্ধ সমালোচকের কাছে ‘অপন্যাস’ (?) হয়ে থাকল দীর্ঘদিন। ড. হুমায়ুন আজাদ ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ নামের একটি কাব্য লিখে উৎসর্গ করলেন হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনকে! কিন্তু প্রখ্যাত পণ্ডিত আহমদ শরীফ হুমায়ূনের মাঝে পেয়েছিলেন ‘জীবনঘেঁষা শিল্পী’র দেখা। ড. শরীফের মন্তব্য মিথ্যে হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা একাডেমিতে যে বইমেলা শুরু হলো তাতে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যিকদের। সমরেশ, সুনীল, শীর্ষেন্দু ছাড়া মেলা অচল। আহমদ ছফা বিষয়টি উপলব্ধি করলেন এবং আনঅফিসিয়ালি বললেন: মেলায় যদি কলকাতার লেখকদের এতো প্রাধান্য থাকে তবে দেশটা আমরা স্বাধীন করলাম কি কুন্তল ছিঁড়ার জন্য?

এরপর দৃশ্যপট চেঞ্জ হলো। নব্বই দশকের বইমেলা মানেই হুমায়ূনের জয়জয়কার। একবার মেলা কর্তৃপক্ষ হুমায়ূন আহমেদকে বিশেষ অনুরোধে মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বের করে নিয়ে আসেন। হুমায়ূন আহমেদ মেলায় এসেছেন- এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এতো বেশি দর্শক সমাগম হলো যে, পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে গেলো!

সেদিন জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি চিঠি পড়লাম। দুটি চিঠি তাঁর প্রকাশকের কাছে লেখা। পাঁচশ টাকা ধার চেয়ে লেখা চিঠিটা পড়ে অন্তরটা কেঁপে উঠল! কবিতা না লিখে আলু পটলের ব্যবসা করলেও তো জীবনানন্দের এতো সংকট থাকতো না। রূপসী বাংলার শুদ্ধতম কবিও প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন পাঁচশ টাকার জন্য! নজরুলের কষ্টের কথা আর নাই বা বললাম!

প্রথম জীবনে হুমায়ূন আহমেদ প্রকাশকদের সাথে কী ধরনের দরবার করেছেন তা জানি না। তবে একটা সময় প্রকাশকরা চটের ব্যাগে নগদ টাকা নিয়ে যেতেন হূমায়ূনের কাছে। হুমায়ূন লেনদেন করতেন ক্যাশে। ধারণা করেন তো একটা পাণ্ডুলিপির জন্য তাঁকে কত টাকা দিতে হতো?

‘বৃষ্টিবিলাস’ নামে একটা প্রকাণ্ড বাগানবাড়ি (গ্রামের নাম ছিল পিরুজালি, কিন্তু নুহাশপল্লি নামের নিচে চাপা পড়েছে পিরুজালি নাম), সেন্টমার্টিন দ্বীপে ‘সমুদ্রবিলাস’ নামে একটি রেস্টহাউজ বানিয়েছেন তিনি। নিজগ্রামে ‘শহিদ স্মৃতি বিদ্যাপিঠ’ নামে একটি স্কুল করেছেন নেত্রকোণায়। অনেক চেষ্টা করেও তিনি বেঁচে থাকতে প্রতিষ্ঠানটির এমপিও পাননি! এদেশে যদু মধু কদুর স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি রাতারাতি এমপিও পায়! হুমায়ূনের স্কুল পায় না! আফসোস!! স্কুলটি তিনি করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাস্বরূপ। তাঁর বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। মা আয়শা আখতার একজন সংগ্রামী ও মহীয়সী নারী। তাঁর ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব (কার্টুনিস্ট) স্ব স্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল। বোনরাও প্রতিষ্ঠিত।

তিনি বাদশাহী জীবন যাপন করেছেন। সুনীল নিজে একথা বলেছেন। নাটক ও সিনেমায় তিনি বাংলা চিত্রজগতে ব্যতিক্রমী ও অনন্য, নির্মাণের মহান কারিগর। তিনি ছিলেন এক মুগ্ধকর। বাংলা নাটকে নতুন ভাষারীতি, সংলাপ, কাহিনি-প্লট হুমায়ূনের হাতে পেয়েছে পূর্ণতা। তাঁর সৃষ্ট হিমু, মিসির আলী, রুপা, বাদল, নান্দাইলের ইউনুস, বাকের ভাই, মীরা, নবনী, রাবেয়া আপা, খোকা, এশা, জয়নাল, শুভ্র আমাদের পরম আত্মীয়। এখনো আমরা ‘অপেক্ষা’ পড়ি সিক্ত চোখে, ‘রূপার পালঙ্ক’ পড়ি রোমাঞ্চ নিয়ে, ‘গৌরীপুর জংশন’ পড়ি উত্তেজনা নিয়ে। তাঁর ‘দেয়াল’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে রাজনীতি ও সমকাল গভীর তাৎপর্যে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। সমকালীন নানা সংকটে আমরা তাকিয়ে থাকতাম হুমায়ূনের কলমের দিকে। আমাদের দ্বিধা কাটত, সংশয় কাটত, আমরা স্বপ্ন দেখতাম নতুন দিনের।

আমাদের শৈশবগুলো বর্ণিল হতো হুমায়ূনের ‘আজ রবিবার’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘জোছনার ফুল’ নাটকগুলোর কারণে। আমাদের দুপুরগুলো রঙিন হতো চমৎকার মলাটে, প্রচ্ছদে আর নামে প্রকাশিত হুমায়ূনের উপন্যাসগুলোর জন্য। একটা উপন্যাস শুরু করলেন, শেষ হচ্ছে না, আবার আপনি উঠতেও পারছেন না, বুঝবেন লেখকের নাম হুমায়ূন আহমেদ। সৈয়দ শামসুল হক এক লেখায় বলেছিলেন : হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকবেন তাঁর ছোট গল্পের জন্য।

সোয়া শ’র মতো ছোটগল্প তিনি লিখেছেন। জীবনের বিচিত্র বিষয় সেখানে পাবেন। মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন প্রান্ত নিয়ে লেখা গল্পগুলো তাঁরই সৃষ্টি। নাটক ও সিনেমার প্রয়োজনে অনেক গানও তিনি লিখেছেন।

প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন গুলতেকিনকে। একসময় তাদের ডিভোর্স হয়। আবার বিয়ে করেন অভিনেত্রী শাওনকে। দুই পক্ষে ছয় সন্তানের জনক তিনি। তিন পুত্র- নুহাশ, নিষাদ, নিনিত; তিন কন্যা- শিলা, নোহা, বিপাশা।

ডিভোর্স পরবর্তী নিঃসঙ্গ জীবন নিয়ে তিনি বানিয়েছেন ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ সিনেমা। ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ তাঁর শেষ সিনেমা। ‘আগুনের পরশমণি’ ও ‘শ্যামলছায়া’য় আছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও বিরহগাথা। তাঁর ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমাটি ঢাকার ‘আনন্দ’ সিনেমা হলে একটানা ছয়মাস চলেছে!

২০১২ সালে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নিউইয়র্কে। নুহাশপল্লিতে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চলছে গবেষণা। ছোটবেলা থেকে আমি হুমায়ূনের ভক্ত ছিলাম। তাঁর শতাধিক উপন্যাস আমি পড়েছি ইন্টারমিডেয়েটে থাকতেই! এখনো কোনো বাড়ির বুকশেলফে হুমায়ূনের কোনো বই দেখলে বুকের মাঝে সুখের মতো ব্যথা হয়। হুমায়ূনের বই চুরি করা আমার অভ্যাস! কিন্তু এখন সামাজিকতার জন্য পারি না বলেই বুকে ব্যথা!

এই মহান কারিগরের ছোটগল্প নিয়ে যতদূর জানি আমিই প্রথম এম.ফিল. ডিগ্রি লাভ করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আমার তত্ত্বাবধায়ক পিতৃতুল্য (আড়ালে তাঁকে বাপই ডাকি) Gias Shamim স্যারের প্রতি আবারো কৃতজ্ঞতা। আগামী বইমেলায় বইটি প্রকাশের ইচ্ছা আছে।

আজ হুমায়ূনের প্রয়াণদিবস। বাংলার জল-জোছনার পাগল এই মানুষটিকে আল্লাহ ভালো রাখুন। তাঁর সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা ও তাঁর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিরন্তর।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *