প্রথম পাতা » মতামত » প্রজা দরদী এক জমিদার কবি

প্রজা দরদী এক জমিদার কবি

Rabindranath Tagore

জমিদারির প্রথাগত দম্ভ, লালসা, অহমিকা, শাসন, শোষণ এসব কিছুকে ছাড়িয়ে তিনি ছিলেন মানুষ কবি- মানুষের কবি। তিনি প্রজা দরদী এক জমিদার কবি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

মানুষের অভাব, দুঃখ দূর করার জন্য মানুষের নিজস্ব সক্ষমতার কথা বার বার বলেছেন। তিনি বলেছেন- মানুষের মাঝেই আছে সম্পদ সৃজনের লুকায়িত ক্ষমতা। আছে অপার সম্ভাবনা। সঠিকভাবে এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারলেই দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব। ধনী—দরিদ্রের বৈষম্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন- সমাজের বৃহৎ অংশকে নিচে ফেলে উন্নয়নের শিখরে উঠার অংকার করা যায় না। তাঁর কবিতায় একই বিষয়ের প্রতিধ্বিনি শোনা যায়- “যারে তুমি নীচে ফেল তোমারে বাঁধিবে সে নীচে/ পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে/ পশ্চাতে টানিছে।”

দারিদ্র্যতা শুধুমাত্র ধনের নয়, মনেরও। মনের দরিদ্রতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন- ভালো করিয়া ভবিয়া দেখিলেই দেখা যাইবে দারিদ্যের ভয়টাও ভুতের ভয়। এটা কাটিয়া যায় যদি আমরা দল বাঁধিয়া দাঁড়াইতে পারি। বিদ্যা বলেঅ, পাকা বলো, প্রভাপ বলো, ধর্ম বলো- মানুষের যা কিছু দামী এবং বড় তাহা মানুষে দল বাঁধিয়াই পাইয়াছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন- বালি জমিতে ফসল হয়না। কেননা তাহা আঁটা বাঁধে না, তাই তাহাতে রস জমে না। ফাঁক দিয়া সব গলিয়া যায়।

প্রজা দরদী রবীন্দ্রনাথ কৃষকের দুঃখ—দুর্দশা নিয়ে খুব ভাবতেন। সেসময় সাধারন মানুষের মাঝে ব্যংক বলে কোনো ধারনাই ছিলোনা। তখন তিনি প্রজাদের মিতব্যয়িতা, সংঘবদ্ধ হয়ে কর্ম, এবং সহায়তার অভ্যাস শিক্ষা দেয়ার জন্যে ১৯০৫ সালে পতিসরে কৃষকের জন্য কৃষি ব্যাংক স্থাপন করলেন। তার ব্যাংক খোলার পর বহু গরীব প্রজা প্রথম সুযোগ পেল ঋণমুক্ত হওয়ার।

আশাহীন মানুষের মাঝে ভরসা যোগাতে তিনি বলেছেন- সকল দেশেই গরীব বেশি ধনী কম। তাই যদি হয় তাহলে কোন দেশকে বিশেষ করিয়া গরীব বলিব? যে দেশে গরীব ধনী হইবার ভরসা রাখে সেদেশে সেই ভরসাই একটা মস্ত ধন। আমাদের দেশে টাকার অভাব আছে একথা বলিলে সবটা বলা হয়না। আসল কথা, আমাদের ভরসার অভাব। তাই যখন আমরা পেটের জ্বালায় মরি তখন কপালের দোষ দেই। একথার মাধ্যমে তিনি মানুষকে ভাগ্যের দোষ না দিয়ে নিজেদের মিলিত সামর্থ্য নিয়ে ভাগ্য পরিবর্তের কথা বোঝাতে চেয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ বহু দেশ ভ্রমণ করে আহরিত জ্ঞান বাস্তবে কাজে লাগাবার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি জার্মানি ও আয়ারল্যান্ড থেকে সমবায়ের সাফল্যের উদাহরণ গরীবী হটাতে কাজে লাগাবার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি তাঁর নোবেল বিজয়ের অর্থ দিয়ে সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন। সমবায় সম্পর্কে তিনি বলেছেনÑ একা অন্ন ভক্ষণ করা যায়, তাতে হয়তো পেট ভরে। কিন্তু পাঁচজন মিলে খেলে পেটও ভরে, আনন্দও মিলে এবং স¤প্রীতির ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়।

কৃষির সম্ভাবনা এবং কৃষিকে আধুুনিকায়নের কথা বহু আগেই তিনি ভেবেছিলেন। তাই তিনি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং তাঁর বন্ধুপুত্র সন্তোষ মজুমদারকে অক্সফোর্ডে না পড়িয়ে আমেরিকার ইলিনয়েজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিতে উচ্চশিক্ষ লাভে জন্য পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাঁর জামাতা নগন গাঙ্গুলিকে জ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ, পশুপালন সম্পর্কে উন্নত শিক্ষার জন্য বিদেশ পাঠিয়েছিলেন।

একজন প্রজাদরদী জমিদার রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবেও জমিদার তিনি। মানুষের জন্য, দেশের জন্য, সমাজ ও শিল্প এবং সংস্কৃতির জন্য তার ভাবনা যুগে যুগে আমাদের আলোকিত পথের সন্ধান দেবে…..

পঁচিশে বৈশাখ, ১৪১৯ বঙ্গাব্দ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫১তম জন্মবার্ষিকী।
১২৬৮ বঙ্গাব্দের (৬ মে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ) এইদিনে অবিভক্ত বাংলার কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে তার জন্ম।

কবি রবীন্দ্রনাথ যত বড় মাপের কবি তারচেয়ে অনেক বড় মাপের পণ্ডিত এবং দার্শনিক তিনি। তিনি নারী ও মানবতার মুক্তির সাথে সাথে তাদের শিক্ষার জন্য কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গান সঙ্গীতের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ অবিনাশী কীর্তি।

বাংলা সাহিত্যকে তিনি বিশ্ব অঙ্গনে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি প্রথম এশীয় হিসেবে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীর প্রেমময়। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর, খুলনার দক্ষিণডিহি ও পদ্মার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল কর্ম ও সাধনার। বাংলাদেশের সবুজ ভূমিতে তার শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো রচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে তার গান বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর তার লেখা গান ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায়।

প্রতিবেশী দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতও তার লেখা। তিনিই একমাত্র কবি যিনি তিনটি দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। তিনি নারী ও মানবতার মুক্তির সাথে সাথে তাদের শিক্ষার জন্য কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই সঙ্গে কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যাভিনেতা, সংগীত রচয়িতা, সুরকার, গায়ক ভাষাবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিত্রশিল্পী। সাহিত্যের সমান্তরাল তিনি ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি ও সমাজভাবনা সমানভাবে চালিয়ে গেছেন।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

S M Mukul
এস এম মুকুল
লেখক-কলামিস্ট, হাওর ও কৃষি অর্থনীতি বিশ্লেষক

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *