প্রথম পাতা » মতামত » কিশোর অপরাধের কারণ ও শিশু আইন

কিশোর অপরাধের কারণ ও শিশু আইন

Juvenile delinquency

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সংখ্যা ও ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে কিশোর অপরাধ প্রবণতা। শিশু কিশোরদের একটি বড় অংশ জড়িয়ে পড়ছে মাদক সেবন, চুরি, ছিনতাই, কিশোর গ্যাং, ধর্ষণ ও হত্যার মত বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রমে। এতে করে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।

উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে মারামারি ও প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটছে। ক্ষমতার আধিপত্য ও প্রভাব টিকিয়ে রাখতে কিশোর গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির মত ঘটনা রীতিমত ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। কিন্তু কেন এত কিশোর অপরাধ?

অপরাধ বিজ্ঞানী বিসলার এর মতে- প্রচলিত সামাজিক নিয়মনীতির উপর অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরদের অবৈধ হস্তক্ষেপ ই কিশোর অপরাধ।
অপরাধ বিজ্ঞানী বার্ট বলেছেন- কোন শিশুকে তখনই অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে যখন তার অসামাজিক কাজ ও অপরাধ প্রবণতার জন্য আইনগত ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ে।

অপরাধ বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পারিবারিক প্রভাব, মানসিক বিকাশজনিত সমস্যা, অর্থনেতিক দুরাবস্থা, দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, প্রতিবেশীদের প্রভাব, ভৌগলিক অবস্থান, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক দর্শন, সাংস্কৃতিক দ্বন্ধ ও মিডিয়া- ব্যক্তি বিশেষে অপরাধ কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। প্রভাবকগুলো ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন হয়।

মনোবিজ্ঞানী গগার্ড কিশোরদের এ ধরণের অপরাধ প্রবণতার জন্য মানসিক অক্ষমতা ও অসুস্থতাকে দায়ী করেছেন। দৈহিক ও স্নায়ুতন্ত্রের ত্রুটিপূর্ণ গঠনের জন্য ব্যক্তির অস্বাভাবিক আচরণও অপরাধ প্রবণতার জন্য দায়ী। তাছাড়া মনোবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ ত্রুটিপূর্ণ ও অস্বাভাবিক দৈহিক বিকাশকে অপরাধ প্রবণতার জন্য দায়ী করেছেন।

মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ড. হিলি শিকাগো শহরে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, কিশোর অপরাধীদের ৩১% এর দৈহিক বিকাশ অস্বাভাবিক। এছাড়াও ইতালিতে সাম্প্রতিক গাবেষণায় প্রতীয়মান হয় যে, দৈহিক অক্ষমতা দূর করা গেলে কিশোরদের অপরাধমূলক আচরণ থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। 

আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী এডউইন সাদারল্যান্ড শিশুর অপরাধ প্রবণতার জন্য পারিবারিক প্রভাবকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন। কারণ একটি শিশু তার অধিকাংশ সময় পরিবারের সদস্যদের সাথে কাটায়। পরিবারের বড় সদস্যদের অপরাধ মূলক কার্যক্রম শিশুটি সহজেই রপ্ত করে নেয়।

শিশুর অপরাধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ার পেছনে বিভিন্ন জোরালো কারণ থাকলেও সবচেয়ে বেশি দায়ী পরিবার। পরিবারের সদস্যদের অবহেলাপূর্ণ বৈরি মনোভাব, সন্তানের প্রতি উদাসীনতা অপরাধ জগতের পথকে ত্বরান্বিত করে।

তাছাড়াও বিবাহ বিচ্ছেদ, অভিবাবকের মৃত্যুজনিত কারণে সন্তানকে নিয়ন্ত্রণের অভাব, অসুস্থতা বা অজ্ঞতা, বাবা মায়ের অবাধ ঝগড়া, একে অন্যের উপর অযাচিত কর্তৃত্ব, সৎ মায়ের অবহেলাপূর্ণ আচরণ, অভিভাবকের উদাসীনতা, অধিক সন্তান গ্রহণে সন্তানের প্রতি অমনোযোগী মনোভাব, বাবা মায়ের অনৈতিক কার্যক্রম, দারিদ্র্য ইত্যাদি কারণও কিশোর অপরাধী হওয়ার পেছনে প্রভাবক হিসবে কাজ করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিতে মিডিয়ার প্রভাব উল্লেখযোগ্য। অধিকাংশ সিরিয়াল ও সিনেমা হলের মুভিতে চিত্রায়িত সহিংসতার দৃশ্য উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের বাস্তব জীবনকে
সহিংস করে তুলেছে। ব্রডকাস্টিং গ্রুপ অব হাউস অব লর্ডস (Broadcasting Group of House of Lords) পরিচালিত এক জরিপে বলা হয় ব্যক্তির আক্রমণাত্মক ব্যবহারের সাথে মিডিয়া সৃষ্ট সহিংসতার গভীর আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান। বর্তমানে কিশোর অপরাধের ধরন পাল্টেছে। অধিকাংশ
কিশোর অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে ডিজিটাল প্লাটফর্মকে ভিত্তি করে।

কিশোর অপরাধ রোধ করতে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের উপর। সন্তানের সাথে বাবা মায়ের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক নিশ্চিত করা, বাবা মায়ের পারস্পারিক সম্পর্ক অনেকাংশে সন্তানের সুস্থ মানসিক বিকাশে সহায়তা করবে। তাছাড়াও দারিদ্র্য দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

শিশু আইন

কিশোর অপরাধ দমনে বাংলাদেশে প্রচলিত আইনগুলোর মধ্যে শিশু আইন ২০১৩ ও প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০ উল্লেখযোগ্য। কিশোর অপরাধীদের সংশোধন করার লক্ষ্যেই আইনের বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে মানসিক উৎকর্ষতা সাধন, শারিরীক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সাধন এ আইনের প্রধান লক্ষ্য।

১৯৭৪ সাল থেকে আমাদের দেশে শিশুদের জন্য পৃথক বিচার ব্যবস্থার সূচনা হয়। ১৯৭৪ সালের শিশু আইন ও ১৯৭৬ সালের যে শিশু নীতি তা এ বিষয়ে আমাদের প্রথম আইন ও বিধি। কিন্তু ১৯৭৪ সালের আইনটিই শিশুদের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন, যা ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। 

কিন্তু কিশোর আদালত- শিশু বা কিশোরের কোনো গুরুতর অপরাধ আমলে নিতে পারে না। এ মামলাগুলোর বিচার হয় জেলা ফৌজদারি আদালতে যা কিশোর আদালতের এখতিয়ারের সীমাবদ্ধতা।

২০১৩ সালে সংশোধিত শিশু আইনটি বর্তমানে কার্যকর আইন হলেও এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন এখনো সম্ভব হয় নি। এটি শিশুদের অধিকার ও বিচারের ক্ষেত্রে একটি আর্ন্তজাতিক মানসম্পন্ন আইন। কিন্তু সক্ষমতার অভাবে এ আইনের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশু কিশোর তথা রাষ্ট্র। সক্ষমতা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।

পরিশেষে, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের পাশাপাশি পারিবারিক সচেতনতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ তৈরির মাধ্যমে দেশে কিশোর অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে পরিবারের সকল সদস্যদের বিশেষ করে বাবা-মা কে এ বিষয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে।

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

মাহমুদুল
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *