প্রথম পাতা » গল্প » নীলক্ষেতে

নীলক্ষেতে

আমার বাল্যবন্ধু সাজ্জাদ হোসেন ওরফে সুজনের সাথে দেখা হয়ে আড্ডা হলে তা আমার মনে দাগ না কেটে পারেনা, দাগ কাটার মতো কিছু না হলেও। ছোটবেলার বন্ধুদের প্রতি মানুষের এক ধরণের শিশুসুলভ মায়া মহব্বত সব সময়ই থেকে যায়। এসব বন্ধুদের আমরা পাই আমাদের সবচেয়ে নরম কচিকাঁচা বয়সে, যখন জগতের সবকিছুই মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। যৌবন কাটিয়ে বার্ধক্যে উপস্থিত হওয়ার পরও ছোটবেলার বন্ধুদের দিকে তাকালে তাদের ক্লাস ফোরের ছাত্র বলেই মনে হয়। আমার বন্ধু সুজন আর বায়েজিদের মুখের দিকে তাকালে আমি ভাবতেই পারিনা একজন এখন ছেলের বাবা আর অন্যজন জীবনের নানা ঘাটে পোড় খেয়ে এখন সদরঘাটের মতো জায়গায় আমদানী রফতানীর বড় ব্যবসায় টিকে আছে। সুজন এসব আমদানী রফতানীর ফাঁকেও লেখালেখিটা চালিয়ে যাচ্ছে। চীনা একটা পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত লেখালেখি করে, টাকা পয়সাও কিছু পায়। যাহোক, আমার মুখের দিকে তাকালে ওদের মনে নাকি একটা স্মৃতিই বেশি ভেসে উঠে, আমি টিফিন পিরিয়ডে পাকুটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাই বেঞ্চের নিচ দিয়ে ছোটাছুটি করছি।

গত শনিবার কিছু বইপত্র কেনার জন্য নীলক্ষেত গিয়েছিলাম। বাসা থেকে রিক্সায় উঠেই সুজনকে ফোন করলাম। “তুই কই, আমি নীলক্ষেত আসতেছি, কাছাকাছি থাকলে চলে আয়”। “আচ্ছা তুই নীলক্ষেত মোড়ে আইসা আমারে ফোন দে”। এবারকার ঈদ পাকুটিয়ায় করলেও কোন বন্ধুদের সাথে দেখা হয় নাই। চাঁদ রাতে জমিদার বাড়ির মাঠে বসে সুজন আর বায়েজিদকে ফোন করে জানতে পারলাম সুজন আসবে ঈদের পরেরদিন, আর বায়েজিদ পাকুটিয়া বাজারেই ছিল, আড্ডা দিচ্ছিল, এখন ভ্যানে করে চলে যাচ্ছে আউটপাড়া ওদের গ্রামে। আমি পাকুটিয়ায় আসি নাই মনে করে আমাকে ফোন দেয় নাই। ভ্যানে করে ইতিমধ্যেই হাড়িপাড়া গ্রামের বটতলা পর্যন্ত চলে গেছে, এখন আর ফেরত না এসে আগামীকাল বা পরশু দেখা হবে। কিন্তু এবার আর দেখা হয় নাই।

জমিদার বাড়ির মাঠে অনেকেই গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে, আকাশে চাঁদ, দক্ষিণ দিক থেকে মৃদুমন্দ বাতাস আসছে। এরকম চাঁদ রাতে আমরাও সব বন্ধুরা মিলে প্রায় প্রতি ঈদেই আড্ডা দিয়েছি। বিগত কয়েক বছর ধরে আর হচ্ছে না সেসব আড্ডা। করোনা একটা কারণ হলেও, আসল কারণ জীবনের বদলে যাওয়ার নিয়ম। সাংসারিক আর জাগতিক বাস্তবতায় পড়ে মনের বৈরাগী, ব্রহ্মচারী আর ভবঘুরে স্বত্তাটা আস্তেধীরে কবে কোথায় কিভাবে হারিয়ে যায় কিংবা ক্ষয়ে যায় তা টের পাওয়া গেলেও রোধ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। কেউকেউ যে পারেনা তা নয়, অনেকেই উপরের তলা আর নিচের তলা দুই ঘরই ভারসাম্য দিয়ে ঠিক রাখতে পারে। আমার বন্ধু সুজন সেরকম একজন। সুজনের নিচের তলায় সদরঘাট থাকলেও উপরের তলায় আছে উঁচু চিন্তা, জীবনের আনন্দ বেদনা নিয়ে গভীরতর বোধ। সদরঘাট, জীবনের জাগতিক হিশাব নিকাশ, সংসারের চুলচেরা আদান প্রদানের অংক, লাভ-ক্ষতির শতকরা হিশাব, জমিজমার ইঞ্চিইঞ্চি খারিজ ফারাজের ফয়সালা, হিংসা-বিদ্বেষ, কূটচাল, কুচুটিপনা এসবকিছুর ভেতর দিয়ে গিয়েও জীবনের উপরতলার ঘরের স্বচ্ছতা, নৈতিকতা, ভালো মন্দের ভেদাভেদ জ্ঞান বজায় রাখাই আসল বৈরাগ্য, আসল মোহমায়াহীন জীবনের স্বরূপ। টাকা পয়সা জমি জিরাত জীবনে দরকার নাই তা নয়, কিন্তু এসব পেতে গিয়ে, করতে গিয়ে ৭০-৮০ বছরের জীবনের মধ্যে অসীমতা, মহিমা আর অমরত্বকে ধরতে পারার যে সম্ভাবনা আছে তা কলুষিত করা, নষ্ট করা বা হারিয়ে ফেলা অনুচিতই হবে। আমার উচিৎ অনুচিত জ্ঞান যে অনেক টনটনে তা না। আমি উচিত জায়গায় অনুচিত কথা আর কাজ, আবার অনুচিত জায়গায় উচিত কথা আর কাজ বলতে আর করতে গিয়ে প্রায়ই যাকে বলে ধব্ব্যে ঠেকি, বিব্রত হই, বিপদে পড়ি, মারপ্যাঁচে আটকে যাই। এতে করে উচিৎ অনুচিত জ্ঞান বাড়ে বৈ কমে না। ঠেকায় পড়েই বাড়ুক আর যেভাবেই বাড়ুক। জীবন মানে বয়স বাড়া না, জ্ঞান বাড়া। সুজনের কথাবার্তায় বুঝা যায় জীবন সম্পর্কে ওর যথেষ্ট জ্ঞান বেড়েছে, শুধু সাংসারিক সাফল্য বলতে যা বুঝায় একমাত্র তাই ওর হয়নি। সাফল্য কি, কেন কিভাবে তার ফয়সালা করাটা দুরূহ তা বলতেই হবে। আমার চোখে সুজনের সাফল্য ওর জীবনবোধ। “জীবনবোধ দিয়ে, ত্যালত্যালা দর্শন দিয়ে, উপরতলা নিচতলার জ্ঞানী জ্ঞানী কথা দিয়ে জীবন -সংসার চলে না, সংসার জীবন চলে অর্থ কড়ি দিয়ে”। এসব কথায় আমি বাক্যহীনভাবে পরাস্ত। সুজনকে আমি মহিমান্বিত বা গ্লোরিফাই করছি তা না। সুজনের উপর তলার ঘর যে ঠিক আছে তা আমি হলফ করে বলতে পারি।

মিরপুর রোড দিয়ে সোজা নীলক্ষেত যেতে পারলাম না, সায়েন্স ল্যাবের সিগন্যাল থেকে ট্র্যাফিক পুলিশ রিক্সা ঘুরিয়ে দিল। আমি আইডিয়াল কলেজের সামনে দিয়ে হাতিরপুল আর কাঁটাবন হয়ে নীলক্ষেত থানার সামনে গিয়ে নামলাম। রাস্তার উপরের কয়েকটা পুরাতন বইয়ের দোকান পাড় হয়েই চোখে পড়ল সুজনের পার্ক করা মোটরসাইকেল আর ও দুই হাত প্রসারিত করে সামনে আসতে আসতে “ডিডি” বলে কুলাকুলি করল। সুজন এক বিচিত্র কারণে আমাকে মাঝেমাঝেই ডিডি বলে ডাকে। বিশেষ করে অনেকদিন পর দেখা হলে, এই ডিডির মানে কি জিজ্ঞেস করে সদুত্তর পাই নাই।

দুইজন টুকটাক কথা বলতে বলতে হেঁটেহেঁটে ম্যাগাজিনের গলিতে গেলাম। সাজ্জাদ দুঃখ করে বলল, এখন আর কেউ তেমন বই পড়ে না, সবাই শুধু দেখে, দর্শক; পাঠক নয়। আমি পুরোপুরি একমত না হলেও বললাম, তা কিছুটা ঠিক বৈকি। তবে যারা এখন বই পড়ে তারাই এক সময় এগিয়ে থাকবে, তাই বলে সিনেমা নাটক টিভি সিরিজ এসব দেখবে না তা নয়। পাঠকও দরকার, দর্শকও দরকার। সবাইকেই দরকার। দেখাও এক ধরনের পাঠ। তেমনি শোনাও। আসল হলো পাঠের নিয়ত। এক সময় মানুষ সিনেমা ছায়াছবিকে “বই” বলত। “আজকে বিটিভিতে ভালো একটা সামাজিক বই দেখলাম, কোন মারামারি নাই”। আগে, এমনকি এখনও অধিকাংশ সিনেমা, টিভি সিরিজ বানানো হয় কোন না কোন উপন্যাস বা গল্প অবলম্বনে। কমিক্সের বিষয়টা তো আছেই। তবে যেভাবেই বলা হউক না কেন, বই পড়ার ব্যাপারটা সবকিছু থেকে আলাদা আর বিশেষ কিছু বলেই আমি মনে করি। আমি নিজে যে অনেক বই পড়ি তা নয় আর পড়লেই যে বই পড়া নিয়ে ভাষণ দিতে হবে তাও নয়। নীলক্ষেতের অলিগলিতে দুই এক ঘন্টা ঘুরাফেরা করার পর নিজেকে অনেক বড় পাঠক মনে হলে কেউ যদি আমাকে “মুই কি হনুরে” ভাবে তাতে কাউকে দোষ দেয়ার উপায় নাই।

ম্যাগাজিনের গলির ডানপাশের কয়েকটা দোকানে বেশ অনেক বাংলা বই বিক্রি করে। ইংরেজি বইও আছে,তবে সংখ্যায় কম। নীলক্ষেতে বেস্টসেলার ইংরেজি বইয়ের ফটোকপি ভার্সন পাওয়া যায় তা তো মান্ধাতার আমলের ব্যাপার। জনপ্রিয় বাংলা বইয়ের কপিও কম দামে হরহামেশা পাওয়া যায়। বেশ অনেকদিন ধরে এসব কপি বইয়ে চোখে পড়ার মতো একটা পরিবর্তন এসেছে। কিছুকিছু কপি করা বই দেখতে অরিজিনাল বইএর চেয়েও ভালো মনে হয়। কাগজের মান, বাঁধাইয়ের মান, কাভার, বুকমার্ক সব মিলিয়ে আসল আর নকলের মধ্যে পার্থক্যটা ধরা বেশ কঠিনই মনে হয় আমার কাছে। পশ্চিমবঙ্গের কিছু বই এমন করে কপি করা যে, দেখে মনে হয় একদম অরিজিনাল। নজর করে দেখলে ভেদাভেদটা চোখে পড়ে। সন্মাত্রানন্দ, কৌশিক মজুমদার, শ্রীপান্থ আর কল্লোল লাহিড়ীর লেখা কিছু কপি করা বই কিনলাম, দামাদামি করে সস্তা দরে। দোকানি বুঝতে পেরেছে, আর যাই হউক, এই লোকের আসল আর নকলের পার্থক্য বুঝার কিছুটা হলেও জ্ঞান আছে। কিন্তু টাকা পরিশোধ করার পর আমার মনে হতে থাকল, আজকেও ঠকে গেলাম।

আজিজ সুপার মার্কেটে কিংবা পাঠক সমাবেশে যাব কিনা ভাবতে ভাবতে দুইজন হেঁটে আবার গেলাম নীলক্ষেত থানার সামনে। মোটরসাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে কোথায় বসা যায় তা ভেবে আমি বললাম, চল পলাশী যাই, ঠান্ডা জুস খাই। পলাশী যাওয়ার আগে গেলাম ঢাকা মেডিক্যালের শহীদ মিনার গেটে। সুজনের একটা ছোট্ট কাজ আছে। পলাশীর কাঁচা বাজারের পাশের পুরাতন জুসের দোকানে বসে দুইজন দুই গ্লাস আনারসের জুস খাওয়া শেষে বসলাম ভিসি চত্বরের সুবিশাল গাছের ছায়ার নিচে। আর কোথাও বাতাস না পেলেও এখানে বসে শরীরটা ঠান্ডা হয়ে গেল। কিছুকিছু জায়গা থাকে যেখানে সব সময় বাতাস থাকে। পাকুটিয়া ইউনিয়নের হাড়িপাড়া গ্রামের বিশাল বটগাছের তলা সেরকম একটি জায়গা। বটগাছের নিচেই বড় একটি পুকুর। দুপুরে আর বিকেলে বটগাছের ছায়ায় পুকুর পাড়ে আমিও অনেকদিন বসে থেকেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে বসে হাড়িপাড়া গ্রামের বটগাছের কথা মনে পড়ায় নিজেকে হাড়েগোস্তে গ্রাম্য বলে মনে হল। এই মনে হওয়ায় আমার কোন কুণ্ঠাবোধ নেই।

ভিসি চত্বরে বসে ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য রীতিতে নির্মাণ করা সাদা রঙের ভিসি বাসভবন এর দিকে তাকালেই আমার আহমদ ছফার “গাভী বিত্তান্ত” বইটার কথা মনে পড়ে যায়। একবার মনে পড়ে গেলে তা আটকানো কঠিন কাজ। আমি আর সুজন এই বই নিয়ে কিছু সরস আলাপ করার এক পর্যায়ে আমার আরেক বন্ধু বায়েজিদকে ফোন করল সুজন। সুজন আর বায়েজিদ আবার চাচাতো ভাই। বায়েজিদ স্কয়ারে চাকরি করে, পোস্টিং হবিগঞ্জ। সিলেটে ঘুরতে যাওয়ার একটা কথার কথা পরিকল্পনা হল। সবাই মিলে পদ্মা সেতুতে ঘুরে আসার পরিকল্পনাও বাদ গেল না। এরকম কত পরিকল্পনা অতীতে মাঠে মারা গেছে, তা জেনেও পরিকল্পনায় দোষ নেই। এসবের সুবাদে কথা যে হচ্ছে তাই কম কি! একসাথে বসা না হলেও, কোথাও যাওয়া না হলেও, কথা তো হল। মানুষে মানুষে সম্পর্ক কিছুটা হলেও স্থান আর সময় দিয়ে নির্ধারিত। স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রতিটা ধাপেই নতুন নতুন বন্ধুবান্ধব হয়। সময়ের এই রেললাইনে সবার উপস্থিতি থেকে যায়, কেউ হয়ে যায় রেললাইনের স্লিপার, কেউবা ব্যালাস্ট আবার কেউবা নুড়ি পাথর। অনেকেই হয়ে যায় সিগন্যাল বাতি। রেললাইনের দুইপাশের গাছপালা, নদীনালা ক্ষেতখামার কেউকেউ যে হয় না তা নয়। এসব মিলিয়েই জীবন নামের রেলগাড়িটা চলতে থাকে, ভালো মন্দ সব মিলিয়ে। চলতে থাকাই জীবন। পুরাতন সেই রেলগাড়ি আর রেললাইনের রূপক দিয়েই নীলক্ষেত থেকে শুরু হওয়া লেখা রেললাইনে এসে শেষ।

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *