প্রথম পাতা » মতামত » প্রসঙ্গ : নারীবিদ্বেষ

প্রসঙ্গ : নারীবিদ্বেষ

misogyny

সমসাময়িক কোনো বিষয় নিয়ে লেখা একরকম বাদই দিয়েছি। যাঁরা আমাকে স্নেহ করেন তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন আমি যেন এসব না লিখি! তাঁরা হয়তো আমার মঙ্গলই চান। কিন্তু ন্যাড়া বেলতলায় একবার গেলেও আমাকে বারবার যেতে হয়।

আমার হাইপারটেনশন আছে। ফলে, একসময় বাংলাদেশের খেলা চরম উত্তেজনা নিয়ে দেখলেও এখন আর দেখি না। ভারতের সাথে বাংলাদেশ জিতেছে- এই খবর ফেসবুকে দেখেছি। বাংলাদেশের পতাকার বিজয়ে মনে একরকম স্বস্তি পাই চিরদিনই। তবে এই খেলায় বিশেষ নৈপুন্য দেখিয়েছে জাতীয় দলে নবাগত তরুণ ক্রিকেটার সিলেটের তানজিম সাকিব। তাকে অভিনন্দন। তার জন্ম ২০০২ সালে। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। একজন জুনিয়র হিসেবে তাকে ‘তিনি’ না বলে ‘সে’ বলা যায়। সম্মানসূচক চন্দ্রবিন্দু ব্যবহারেরও প্রয়োজন দেখছি না। একজন মুসলমান হিসেবে সে আমার ছোটভাই তুল্য।

সম্প্রতি তানজিমের পুরনো কয়েকটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। সেসব পোস্টে সে নারীর চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রি মিক্সিং, জাতীয় দিবস পালন নিয়ে তার মত ব্যক্ত করেছে। বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশ সংবিধানে ধর্মীয় বিধি পালন এবং মানার অধিকার তার আছে। সেই সাথে নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি, দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি অনুগত থাকার বিষয়েও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পতাকার প্রতি ভালোবাসা একেক জাতির কাছে একেক রকম। আমেরিকানরা পতাকার ডিজাইনে অন্তঃর্বাস, বক্ষবন্ধনীও পরে। কিন্তু আমরা সেটা করি না। আমরা পতাকাকে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই, পায়ের তলায় পড়লে দ্রুত তুলে নিয়ে বুকে আগলিয়ে রাখি। এই পতাকা নিয়েই আমাদের তরুণ ক্রিকেটাররা দেশ বিদেশে সফর করে, পতাকাকে সমুন্নত রাখতে ক্রিজে দণ্ডায়মান হয়, কেউ কেউ ভাঙা পা নিয়ে পুরো মাঠ চষে বেড়ায়। ২২ গজের বিজয়ে সারাদেশ আপ্লুত হয়, পরাজয়ে সমগ্র বাংলাদেশ কেঁদে ওঠে। খেলা যদিও শেষ পর্যন্ত খেলাই তবু সেখানে আবেগ থাকে দেশপ্রেমের, মান-সম্মানের, হেরে যাওয়ার গ্লানি কিংবা থাকে বিজয়ের গৌরব।

তানজিম সাকিব ছোট মানুষ। বয়স মাত্র ২১/২২ বছর। তার সম্পর্কে যতদূর জানলাম পড়ালেখা হয়তো বা ততদূর এগুতে পারেনি। কারো কাছে তথ্য থাকলে জানাবেন তার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে। আমি শুধু জানলাম সে ক্লাস এইটে পড়ার সময় ক্রিকেটের দিকে ধাবিত হয়। মনে হয়, সাধারণ কিংবা মাদ্রাসা কোনো দিকেই সে বেশিদূর পড়েনি (তথ্য না পাওয়ায় অনুমান করছি)। সে যা বলেছে সবই তার শোনা কথা অথবা মস্তিষ্কপ্রসূত। সে ভুল করতেই পারে। মানব ইতিহাসের শুরুই ভ্রান্তির মাধ্যমে (আদম হাওয়ার গন্ধম খাওয়ার কাহিনি অনুযায়ী)! তানজিম যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো তাহলে হয়তো তার মন্তব্য আরো রুচিশীল, বাস্তবিক এবং যৌক্তিক হতো। সে যদি ইসলামিক স্কলার হতো তাহলে ও বুঝতো আমাদের নবি স. আরবের জাহেলিয়াত যুগের একজন ব্যবসায়ী নারীকে বিয়ে করেছিলেন। সে আরো পড়ালেখা করলে জানতো কোরআন ও হাদিসে পুরুষকে যতবার সাবধান করা হয়েছে সে তুলনায় নারীকে ততবার নয় কোথাও কোথাও সমগ্র মানবজাতি কিংবা বিশ্বাসীদের ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে। বরং হাদিসে নারী বিদ্বেষী মনোভাবের পরিবর্তে তাদেরকে করা হয়েছে আরো সম্মানীয়া। হযরত আয়েশা রা. হতে যত হাদিস বর্ণিত তত হাদিস সম্ভবত একক কোনো পুরুষের বেলায় হয়নি (হযরত আবু হুরায়রা রা. ব্যতীত) । এখানেও নারীর পরম মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের বিকাশে নারীই প্রথম সম্পদ ও সমর্থন নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। সুতরাং নারীর প্রতি বিদ্বেষ লালন করলে সে বিদ্বেষ হযরত খাদিজা রা., হযরত আয়েশা রা. কিংবা হযরত ফাতেমা রা.দের দিকেই ধাবিত হবে।

আমি যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট চিন্তা করি তাহলে নারীর প্রতি বিদ্বেষ স্পষ্টত সংবিধান লঙ্ঘন। নারীকে কেবল নারী মনে করে কোনো ধরনের সহিংস মনোভাব পোষণ করা অন্যায়ই বলা যায়। নৈতিক বিবেচনাতেও এটি করা উচিত নয়। আমি যে মায়ের গর্ভে লালিত তার জাতকে কীভাবে অবজ্ঞা অবহেলা করব? একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। দেশের সকল পাবলিক পরীক্ষায় নারী শিক্ষার্থীদের জয়জয়কার। তারা এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। বৈশ্বিক চিন্তা করলে দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চন্দ্রযান পাঠানোর পেছনে বহু নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে। এই যুগে এসেও যদি নারীবিদ্বেষই হয় আমাদের একমাত্র বয়ান তাহলে দেশ আর কবে ওঠে দাঁড়াবে। চর্যাপদ কিংবা ঈশ্বরী পাটনির (অনেকে তাকে নারী বলেছেন) কাল থেকেই বাঙালি নারীর সংগ্রাম চিরন্তন সত্য। তবু সে চেয়েছিল সন্তানেরই জয় :

প্রণমিয়া পাটুনি কহিছে জোড় হাতে

আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে

বঙ্গজননীর সন্তানরা দুধভাত খেয়েই তার মাকে নিন্দা করতে নেমে যায়! ভাই, তানজিম তুমি জানো না- বিছানায় কাতরানো অসুস্থ স্বামীর ঔষধ কিনতে, সন্তানের মুখে একমুঠো খাবার তুলে দিতে বঙ্গজননীর যখন উপায় থাকে না তখন সমাজ নষ্টের বাণী তার কাছে তুচ্ছ, সংসার তার চাকরির জন্য ভাঙে না বরং তখন সে টিকে থাকে দু পয়সা উপার্জনের মধ্য দিয়ে। একজন বিধবা মা যখন সন্তানের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায় তখন তার ‘কমনীয়তা’র দিকে তাকানোর সময় নেই। পেটে ভাত না থাকলে আকাশের চাঁদও যখন রুটি বলে ভ্রম হয় তখন কোমলতার ফুলে পেট ভরে না। বাবা-মায়ের একমাত্র অবলম্বন যখন হয় একটি মাত্র মেয়ে তখন এই জমিনে তার কর্মক্ষেত্রে না গিয়ে উপায় নেই। জীবনটা ২২ গজ নারে ভাই! একটা বল মিস হলো তো পরের বলে একটা ফেলে দিলাম! এমন সরল অঙ্কের হিসেবে জীবন চলে না! জীবন বিচিত্র। বৈচিত্র্যেই সৌন্দর্য।

তানজিম এদেশেরই ছেলে। তার প্রতিভা আছে। বাংলাদেশ দলে সে ভালো করবে। এটাকে ইস্যু করে একদল লোক যেন তার ভবিষ্যতকে জলাঞ্জলি না করে সেটা ভেবে দেখতে হবে। তাকে বুঝাতে হবে আমরা যখন ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে খেলি তখন হিন্দুদের বিরুদ্ধে খেলি না, শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট মানে বৌদ্ধ না, ইংল্যান্ড মানে খৃস্টান না। এটি একটি খেলা এবং দিনশেষেও এটি খেলাই। ক্রিকেটে একজন ভালো ব্যাটসম্যান বলে বলে ছয় মারে না। কিছু বল ছেড়ে দেওয়াও ভালো খেলারই অংশ। তানজিমেরও উচিত হবে সব বিষয়ে কথা না বলা। তার উচিত খেলার দিকে মনোযোগ দেওয়া।

তানজিম, তুমি হয়তো জানো না- একটা রানের জন্য যখন তোমরা দৌঁড় দাও তখন আঠারো কোটি মানুষও তোমাদের সাথে দৌঁড় দেয়। এক বলে যখন এক রান লাগে তখন এদেশের কোটি কোটি মুসলমান যেমন জায়নামাজ নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, তখন কোটি কোটি হৃদয় মন্দিরেও ঘণ্টা বেজে ওঠে, মানত হয় ভগবানের দরগায়। যে মেয়েটি হাতে ত্রিশ মিনিট সময় নিয়ে লাঞ্চ করতে আসে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সে-ও এক ফাঁকে শুনে নেয় তোমাদের স্কোর কতো!

যেদিন দুপুরে তোমাদের খেলা থাকে সেদিন সকালে লক্ষ লক্ষ সেলাই দিদিমণিরা অনাবিল স্বপ্ন নিয়ে হাতে টিফিন ক্যারিয়ারসহ ছুটে চলে ফুটপাত ধরে কাতারে কাতারে! একবেলা ছুটির জন্য সেদিন গার্মেন্টসে দরবার হয়! হয়তো মিলেও যায় কাঙ্ক্ষিত ছুটি! ঝড়ের বেগে তারা ছুটে আসে খেলা দেখবে বলে। টিভির সামনে হাতপেতে বসে থাকে তোমার ফেলে দেওয়া দুর্দান্ত একটি উইকেটের জন্য!

লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টসকর্মী মা-বোনের টাকায় তোমাদের সরকারি বেতন হয়! দানের এই অপূর্ব মহিমাকে তুমি কী করে অবজ্ঞা করবে বিদ্বেষের বিষে???

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *