প্রথম পাতা » জীবনযাপন » বাঙালি ‘কইন্যা’র সুখ দুঃখ

বাঙালি ‘কইন্যা’র সুখ দুঃখ

girl child

আজ কন্যা দিবস। কন্যা সংক্রান্ত যে কোনো শুভ সংবাদে আমি মাঝে মাঝে এক ধরনের বিষণ্ণতা বোধ করি। আমার কোনো কন্যা সন্তান না থাকায় সম্ভবত অনুভূতিটা প্রবল। মহান স্রষ্টা আমাকে তিনটি পুত্র সন্তান দিয়েছেন। পুত্ররা মাঝে মধ্যেই তাদের উপস্থিতি ও অস্তিত্বের জানান দেয়। ত্রিপক্ষীয় জটিলতায় ইউক্রেন-রাশিয়া সমস্যা আমাদের কাছে অতি নগণ্য মনে হয়! তখন বৌ হতাশার স্বরে বলে – ‘তিনটা মেয়ে হলে মনে হয় আমাদের জীবনটা শান্ত সমুদ্রের মতো হতো!’ আমরা এখন বাস করছি উত্তাল সমুদ্রে।

তবে শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে জড়িত আছি বলে মাঝে মাঝে সমুদ্র শান্তও হয়! এবার কলেজে টেস্ট পরীক্ষায় যারা দু এক বিষয়ে খারাপ করেছে তাদের অভিভাবক আনতে বলা হলো। এক মেয়ে আমার ম্যাসেঞ্জারে নক করলো, করণীয় জানতে চাইলো। তাকে বললাম- তোমার বাবাকে আনতে হবে।

সে অত্যন্ত আশ্বস্ত-স্বরে বললো- ‘আজ থেকে আপনিই আমার বাপ। আমাকে উদ্ধার করেন। আমি ফেল করেছি একথা আমার বাবা জানলে আমাকে মেরেই ফেলবে।’ কারো ‘পরিপূরক’ বাপ হতে পারার মধ্যে কি কোনো গৌরব আছে? জানিনা, তবে কয়েকজনের ‘কার্যকরী’ বাপ হয়ে তাদের ‘উদ্ধার’ করার চেষ্টা করেছি বৈকি!

বাংলা সাহিত্যে কন্যা সন্তানের প্রতি এক ধরনের প্রবল মায়া আছে হুমায়ূন আহমেদের গল্পে-নাটকে-উপন্যাসে। ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমার এই অংশটুকু আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। আসাদুজ্জামান নুরের সাথে ঐ বাড়ির কাজের মেয়েটির মায়াময় সংলাপ :

– “চেহারা ছবি মাশাল্লাহ সুন্দর হওনে খালি সম্বন্দ আসে। বাপজানে কয় যুদ্ধের মইদ্যে আবার বিবাহ কী? তয় ভাইজান, যুদ্ধ হইছে বইলা কি সব বন্ধ থাকব?”

যুদ্ধের তাণ্ডবে মেয়েটির আর ঘরে ফেরা হয় না। এই ছোট মেয়েটির জন্য দর্শকের মনখারাপ করা বিষণ্ণতা থাকে শেষ পর্যন্ত। ‘লীলাবতী’ উপন্যাসে একটি মেয়ের প্রতি পাঠকের নিদারুণ কষ্ট আচ্ছাদিত করে রাখে বহুদিন। ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসেও এক ধরনের কষ্ট আছে পাঠকের। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র মীরা, নবনী, রূপা, দিলশাদ সহৃদয় পাঠকের মনকে কতো যে কাঁদিয়েছে হিসেব নেই। কন্যাদের প্রতি পিতার কোমল হৃদয়, মায়াবী মাতৃত্ব, স্নেহাস্পদ ভাই কিংবা আশ্রয়ের ভগ্নী চরিত্র রূপায়ণে হুমায়ূনের তুলনা তিনি নিজেই।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে একজন প্রান্তিক কন্যা রতনের প্রতি যে মায়ার ঘোর তৈরি করেছেন তা থেকে পাঠকের বেরিয়ে আসা কঠিন। ‘ফিরিয়া ফল কী! পৃথিবীতে কে কাহার?’ এই সংলাপটিই রতনের কাছে বারবার ফিরে যাওয়ার তাগিদ দেয়, আবেশ তৈরি করে প্রবল শূন্যতার। সৃষ্টি করে দায়িত্বহীনতার সীমাহীন বৈরাগ্য! তাঁর ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে ছোট্ট মিনির প্রতি রহমত শেখের তীব্র ভালোবাসা পিতৃত্বের বাউন্ডারি অতিক্রম করিয়ে বিস্তৃত করেছে আফগান থেকে কলকাতার সীমা। সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসার সীমাহীন প্রকাশ ঘটেছে মিনি একজন কন্যা বলেই। কন্যাকে দিয়েই আদরের প্রকাশ বহুমাত্রিকতা পায় বলে মনে করি। কন্যা অনন্যা, কন্যা নির্ভরতা শুশ্রূষার, কন্যা ভালোবাসা বার্ধক্যের, কন্যা আশ্রয় ভবিষ্যতের। বাবা-মা তাদের সুখ দুঃখের কথকতাগুলো একজন মেয়ের কাছে যতটা নির্দ্বিধায় বলতে পারে পুত্রকে ততটা অসংকোচে বলতে পারে না। ইসলামে কন্যাকে তুলনা করা হয়েছে বেহেশতের সাথে। যার যতজন কন্যা সন্তান, তার ততটা বেহেশত!

সাহিত্য যে কন্যাসন্তানকে দিয়েছে গভীর ভালোবাসা পরিণত বয়সে তাকেই সে বানিয়েছে রহস্যময়ী, ছলনাময়ী, মরীচিকা প্রভৃতি। রবীদ্রনাথ বলেছেন- ‘অর্ধেক মানবী, অর্ধেক কল্পনা’! বঙ্কিম, শরৎবাবুরা নারীর জন্য ত্রাতার ভূমিকায় বসতে পারেননি। শরতের ‘অচলা’ তো একালের ‘বারো…!’ ‘বড়প্রেমের’ দোহাই দিয়ে সটকে পড়েছে শ্রীকান্ত, রাজলক্ষ্মী হয়েছে একা। ‘বিনোদিনী’ হয়ে পড়লো অস্পৃশ্য, সমাজের চোখে নিন্দিত। কুন্দনন্দিনীর সংসার গেলো, কপালকুন্ডলা সংসার বুঝল না বলে তার বাস হলো জংলায়। মানিকের নায়িকারা দুর্বোধ্য, নজরুলের নারী লোভী-নারী দেবী – ‘এরা যত পূজা পায় চায় তত আরো’!

এদেশে নারী যতক্ষণ কন্যাশিশু ততক্ষণ বাবা-মায়ের আদর পায়। কন্যা বড় হলে আর আদর থাকে না। নারী তখন পুরুষের দৃষ্টিকোণে পরিচর্যা পায়। এমন সময় একজন নারী তার আপনজনের কাছেও নিরাপদ নয়, এমনকি কোথাও কোথাও বাবার কাছেও নয়। তাকে তাড়িত করে নষ্টদের আদিম বসনা, পুরুষতন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রের দণ্ড। কোথাও তার মুক্তি নেই।

কন্যা বড় হলে বাবার সাথে, ভাইয়ের সাথে, স্বামীর সাথে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে দেন-দরবার হয় আদালতপাড়ায়-কাঠগড়ায়। এদেশের পিতারা তাদের কন্যাদের প্রাপ্যতা বুঝিয়ে না দিয়ে বেহেশত খোঁজে, ভাই তার বোনের অংশ বুঝিয়ে না দিয়ে স্নেহ ঢালে, স্বামী তার স্ত্রীর মর্যাদা না দিয়ে সুখ খোঁজে।

এদেশে কন্যাদিবস পালন করা সহজ। নারী দিবস পালন করা দুরূহ। কন্যাকে একটি চকলেট দিলেই সে খুশি, নারী হলে সম্পত্তি দিতে হবে কড়াকড়ি!

আসুন, আমরা আড়ম্বর করে এদেশে ‘কইন্যা দিবস’ পালন করি, আর ‘নারীদিবস’ এলে তাদের শক্তহস্তে অবরুদ্ধ করি।

জীবনযাপন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *