প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত হথেকে এই সুন্দরবনই বাংলাদেশকে রক্ষা করে আসছে। একথা বিনা হিসেবেই বলা যায় যে, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বলয় শক্তি ধ্বংস করলে— বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে। এই সুন্দরবন না থাকলে ঝড়—ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছাস, সাইক্লোন, আইলা, সিডর কোনো কিছু থেকেই বাংলাদেশের মহাবিপর্যয়কে ঠেকানো যেত না। অন্যভাবে যদি বলা যায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নির্মম পরিণতির হাত থেকে সুন্দরবন যদি বাংলাদেশকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হতো— তাহলে প্রথমত উপকূলীয় এলাকার কোনো অস্তিত্ব থাকতো বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। সেখানে কোনো জনবসতি, জনমানব এমনকি পশুপাখিও টিকে থাকতে পারতো কিনা সন্দেহ আছে। প্রশ্ন হলো তারপরও কি সুন্দবনের সুরক্ষায় আর কোনো যুক্তি—তর্কের প্রয়োজন আছে? আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই এই অপার সম্ভাবনা, সম্পদ, সৌন্দর্যের প্রতীক সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে।
সুন্দরবন শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিই নয়, এটি বৃহত্তর খুলনা জেলা তথা, দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস হতেও রক্ষা করে আসছে এবং এর মাধ্যমেই এ দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে আসছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন আপন শক্তিতে কাল—কালান্তরের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষাকবচ হিসেবে ভুমিকা রেখে আসছে। ২০০ বছরে ৩০ বার বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো সামুদ্রিক দুর্যোগ আঘাত হানে এ বনের ওপর। এর ফলে গাছপালা ধ্বংস হয় প্রচুর, বন্যপ্রাণীও মারা যায় বিশাল সংখ্যায়। সর্বশেষ সিডর, আইলা, লায়লা, মহাসেনের ব্যাপক বিপর্যয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্বের সর্বগ্রেষ্ঠ ম্যানগ্রোভ অঞ্চল সুন্দরবন, যার ক্ষতি এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের পক্ষে। এখন প্রশ্ন হলো— আমরা সুন্দরবনকে কেন রক্ষা করবনা।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুন্দরবনের অবদান অপরিসীম। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার পাশাপাশি সরকারও প্রতিবছর সুন্দরবন থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। সহস্রাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারির কর্মস্থল এই সুন্দরবনে। সুন্দরবনের জ্বালানি, অভ্যন্তরভাগ ও সমুদ্র এলাকায় বিপুল মৎস্য সম্পদ, বনজ সম্পদ, মধু ও মোম এবং বন্যপ্রাণী সম্পদ সবমিলিয়ে সুন্দরবনকে বাংলাদেশের অর্থনীতির মিনি খনি বললেও ভুল বলা হবে না। আমাদের সুন্দরবন নিছক একটি বনাঞ্চল নয়। অপার সম্ভাবনা এবং সম্পদে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক বনাঞ্চল এই সুন্দরবন। বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত সুন্দরবন একটি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হিসেবেও স্বীকৃত। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার এই সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষের জীবিকায়ন সম্ভব হচ্ছে। অপরদিকে এখান থেকে মধু, কাঠ, মাছসহ অসংখ্য অর্থকরী সম্পদ আহরণ সম্ভব হচ্ছে। সুন্দরবনের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বেস্টনীর ক্ষেত্রে।
সুন্দরবনের ৭৩ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে সুন্দরীবৃক্ষ। সুন্দরী বৃক্ষের আধিক্যের কারণেই বোধকরি এই অরণ্যের নাম সুন্দরবন। বিভিন্ন তথ্যে জানাগেছে, সুন্দরী গাছ ছাড়াও গরান, গেওয়া, গোলপাতা, পশুর, কেওড়া, ধুন্দল, বাইন, কাঁকড়া, সিংড়া প্রভৃতি ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে সুন্দরবনে। বহু বিচিত্র গাছ—গাছালি পরিবেষ্টিত এই গহীন অরণ্যে রয়েছে বাংলাদেশের জাতীয়বিষয়াবলির অন্যতম পরিচায়ক বাংলাদেশের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আরো আছে অজস্র চিত্রল হরিণসহ অসংখ্য প্রজাতির বুনো প্রাণী, পশু—পাখি, কীটপতঙ্গ, জলজ প্রাণী এবং জলজ উদ্ভিজ। ধারণা করা হয়, কমপক্ষে ২৭০ প্রজাতির সরীসৃপ আছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের নদী—নালায় এখন বিরল প্রজাতির মাছের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অতি পরিচিত ১২ রকমের ব্যাঙের অভয়াশ্রম এখনো এই সুন্দরবনে।

জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবন এমনিতেই ডেঞ্জার জোনে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এক দশকে সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। এক গবেষণায় দেখা যায়, সুন্দরবনের যেখানে লবণাক্ততা কম সেখানে ৩০ প্রজাতির, যেখানে মাঝারি সেখানে ২১ প্রজাতির এবং যেখানে বেশি, সেখানে ১৩ প্রজাতির গাছ আছে। এবার বুঝুন কি ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে এই সুন্দবনে। বিশেষজ্ঞ মহল থেকে বার বার বলা হচ্ছে— বেশি মাত্রায় লবণাক্ত পানি সুন্দরবনে প্রবেশ করার কারণে সুন্দরী, পশুর, গরান, বাইন, কাকড়া, গেওয়া প্রভৃতিসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতীর বৃক্ষ ও উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বংশ বিস্তার আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। বন বিভাগের তথ্যে জানাগেছে, ১০ বছরে সুন্দরবনের চাঁদপাই, শরণখোলা, সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় বাস্ট ও উপজয়িং রোগে ৭৫ লাখ গাছ মারা গেছে। হারিয়ে গেছে বেশ কয়েক প্রজাতির উদ্ভিদ। তাছাড়া লবণাক্ততা বাড়তে থাকায় সুন্দরবনের জীবজন্তু, পশু—পাখির আহার—বিহার ও প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। কাজেই সুন্দরবনকে নতুন করে মারার কিছু রেতা নেই। প্রকৃতির প্রলয়ঙ্করি দুযোর্গের সাথে যুদ্ধ করে সুন্দরবন নিজেই আজ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত এবং ক্ষত—বিক্ষত। তার উপর চোরাকারবারি, দশ্যূতা, অস্ত্রের বিকট আওয়াজ, আর পর্যটকদের যত্রতত্র গমন এমনকি অভ্যন্তরে যান্ত্রিক পরিববহনের নানামুখি উৎপীড়নে বিদগ্ধ সুন্দরবন তার প্রাকৃতিক রঙ, রূপ, বৈশিষ্ট্য এবং শক্তিও হারাচ্ছে। একারণে সুন্দবনের বিপক্ষে কোনো উদ্যোগ মানবজাতি নিতে পারেনা। এর পরিণতি ভালো হবেনা। প্রকৃতির নির্মমতা কাউকে ছাড় দেবেনা। যা করার তা বোঝে—শুনে করা উচিৎ। প্রয়োজনে আরো সময় নেয়া উচিত।
আমরা জানি, ১৯৭২ সালে বিশ্বের তাবৎ প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য প্রটোকল প্রণয়ন করে। ১৯৯৭ সালে ১৪০টি দেশ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের সদস্য তালিকায় বাংলাদেশও এই প্রটোকল সই করে। তারপরও সুন্দরবন সুরক্ষার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। একসময় সুন্দরবনের আয়তন ছিল ৯ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি। বর্তমানে সেই আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। তারমধ্যে স্থলভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার ও জলভাগ ১ হাজার ১৮৪ বর্গকিলোমিটার। ভূমিক্ষয় রোধ করা সম্ভব না হলে, বিশেষজ্ঞ মহলের আশংকা অচিরেই সুন্দরবনের কমপক্ষে তিন হাজার হেক্টর জমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হতে পারে।