প্রথম পাতা » গল্প » দেনা-পাওনা

দেনা-পাওনা

Dhaka University

আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান ২০১২ সালের ৪ জুন আমাকে মেরে ফেললেন! আমি বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করলাম! মাস্টার্সের একটা পরীক্ষা তখনো বাকি! বৌকে শখ করে কিছু দিতে পারিনা! কোথাও নিয়েও যেতে পারিনা! টিউশনি করে যা উপার্জন করি তা দিয়ে নিজের পড়ালেখা, বাড়িতে কিছু দেওয়া আর আমার সাতপুরুষের ঋণ শোধ করি! আমার বিয়েতে আব্বা এক লক্ষ টাকা ঋণ করেছিলেন! টিউশনি করে আমি সে ঋণের টাকা শোধ করেছি!

টিউশনির দুনিয়ায় আমি ছিলাম ঐ এলাকায় ‘চোহা মাস্টার’! সে গল্প একদিন করেছিলাম একটি লেখায়। আজ সেদিকে যাব না। আজ হবে চাকরিকথন!

মাস্টার্সের শেষ ক্লাসে শ্রদ্ধের সিরাজ সালেকীন স্যার বলেছিলেন : “ছয়টি মাস পরিশ্রম করো, আগামী ষাট বছর পর্যন্ত ভালো থাকবে!” ব্যস ঐ একটি কথাই ছিল আমার জন্য যথেষ্ট! লোকে আদাজল খেয়ে নামে আর আমি নামলাম পুরোজল খেয়ে!

২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি ঢাকার একটি কলেজে আমি যোগদান করি। আমার প্রথম চাকরি! নামে কলেজ হলেও আসলে কিন্ডার গার্ডেন! আমি পড়লাম অথৈজলে! শ্রদ্ধেয় Tareq Ahmed ভাই আজ তাঁর একটি লেখায় প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বলেছে। আমি হয়ে পড়লাম বিপর্যস্ত! আমি নাটকের জগত থেকে বিদায় নিলেও জীবনের বাঁকে বাঁকে রচিত হতে লাগলো মহানাট্য! একদিকে কলেজের চাপ, অন্যদিকে বৌকালের ঢেউ আমাকে পাগল করে তুললো। একদিন সকালে ফেয়ার এন্ড লাভলি দিয়ে দাঁত মাজলাম! আরেকদিন মোবাইল রেখে টিভির রিমোট নিয়ে কলেজে হাজির! প্রতিদিন মনে হতো এই চাকরিটা কবে ছাড়তে পারব, আল্লাহ!

একদিন ঘটনা ঘটে গেল! ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে আমি প্রায় সাড়ে ছয়শত প্রতিযোগীর মধ্যে প্রথম (মেধানুসারে রেজাল্ট হয়নি, কিন্তু পরে বিশ্বস্তসূত্রে জেনেছিলাম) হলাম! আগের কলেজে তিন মাসের জরিমানা দিয়ে বিদায় হলাম নিভৃতে! আমি সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও বাড়িতে পুলিশও পাঠায় তারা! বাঘে ছুঁইলে আঠার ঘা আর পুলিশে ছুঁইলে নাকি চুয়ান্ন ঘা! তখন টের পেয়েছিলাম। আমার তিন পোলাকে তাদের মা অনেক কিছু হতে বলে। কিন্তু কখনো পুলিশ হতে বলে না!

রেসিডেনসিয়াল ছিল আমার গর্বের জায়গা। ছোট ছোট রেমিয়ানরা অনেক বুদ্ধিমান, আত্মনির্ভরশীল এবং স্মার্ট! আমার ভালো লাগা শুরু হলো! কিন্তু জীবনে তখন আরেকটা স্বপ্ন দেখতে লাগলো বৌ! বিসিএস করা লাগবে! বললাম- পোলাপান পড়াতেই ভালো লাগে যে! তখন সিদ্ধান্ত নিলাম বিসিএস দিয়ে সরকারি কলেজে যাব!

এম.ফিল. এ ভর্তি হয়েছি আগেই। এরই মধ্যে প্রথম পর্বও শেষ হলো। বিসিএসের পড়া, চাকরি, পোলাপাইন জন্ম দেওয়া- কত কাজ! প্রিলি, রিটেন শেষ! এবার ভাইভা! বোর্ড চেয়ারম্যান তৎকালীন একজন ভয়ঙ্কর মানুষ। ওয়াজেদ আলী মহোদয়, লৌহ মানব! সারারাত দোয়া দুরুদ পড়লাম: আল্লাহ আর যাঁর কাছেই পড়ি এই লোকটার বোর্ডে যেন না পড়ি! উনার বোর্ড মানে নিশ্চিত ফেল! সাথে অপমান, লাঞ্ছনা ফ্রি! সালাতুল তসবি পড়ে পিএসসিতে গিয়ে দেখি আমি ওয়াজেদ আলীর বোর্ডে! এবং আমিই প্রথম সিরিয়ালে ! আমি ঝিম মেরে বসে পড়লাম। বুঝলাম, আমার দোয়া কবুল হয় না! হার্টবিট বেড়ে গেলো! এক পর্যায়ে ভাবলাম না দিই ভাইভা! একটা ইতিহাস করি!

বোর্ডে আরেকজন ছিলেন জাহাঙ্গীরনগরের আবু দায়েন স্যার! ভাষাবিদ! আরো একজন মহিলা। তাঁকে চিনি না। শুরু হলো জীবনের প্রথম বিসিএসের ভাইভা! ঐদিন ছিল নজরুলের জন্মদিন। প্লান করে বিশাল এক কবিতা (মানুষ) মুখস্থ করে গেছি! নজরুলে একবার গেলেই হলো! দশ মিনিট খায়ে দিব! প্লানমতোই চলছে। নজরুলের একটা কবিতা আবৃত্তি করতে পারবেন? এ প্রশ্ন শুনেই আমি চিৎকার দিয়ে বলতে চাইলাম: এইবার লাইনে আইছেন, শোনেন তাইলে!

দায়েন স্যার আমার এম.ফিল. বিষয়ক প্রশ্ন করলেন। বাইশ মিনিটের ইতিহাস শেষ হলো! পরে একদিন সুখের কান্নাকাটি করলাম! চোখে আনন্দ-অশ্রু!

জীবন চলছে। হতাশা-ক্লান্তি-অবসাদ নিয়েই জীবন। তারপরও জীবনের সব পরিচয় ছাপিয়ে একটি পরিচয় কখনো কখনো বৃহৎ হয়ে ধরা দেয় আর তা হলো আমি একজন ঢাবিয়ান! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে কী দিয়েছে জানি না তবে আমার মতো অকৃতী, অধমকে কম করে কিছু দেয়নি, অযোগ্য ভেবে যা দিয়েছিল তা আবার কেড়েও নেয়নি। শতবর্ষের এই বিদ্যাপীঠের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিরন্তর।

ঢাবিতে পেয়েছিলাম কয়েকজন বন্ধু। এরাই এখনো আত্মার আত্মীয়। পেয়েছি কয়েকজন বিদগ্ধ পণ্ডিত শিক্ষক। শ্রদ্ধেয় Gias Shamim স্যার, Upal Talukder স্যারের কাছে যে স্নেহ আমি পেয়েছি তা ভুলবার নয়।

চালচুলোহীন অবস্থায় আমি বিয়ে করি। আমার বাড়ি আর আমার শ্বশুরবাড়ির দূরত্ব পনের মিনেটের হাঁটাপথ হলেও কোনো ইয়েটিয়ে ছিল না! বৌকে কোনোদিন দেখিও নাই! আমাকেও সে দেখে নাই!

বৌকে যখন বলি না দেখে বিয়ে করলা কেন? আবারো বেকার? সে বিশ্বাসের সাথে জবাব দেয়: ‘যখন জানলাম তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড় তখনই বুঝেছি তুমি অবশ্যই ভালো কিছু করবে! আর দেখাদেখির মধ্যে যাই নাই!’

একটি অজপাড়াগাঁয়ের মেয়ের মনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অন্তত একটি নিশ্চয়তার ভিত গড়ে দিয়েছে সেটাই বা কম কীসে?

বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনকে বহুবর্ণে বর্ণিল করেছে। কিন্তু আমি হয়তো তাকে কিছুই দিতে পারিনি। যদি কোনোদিন মনের অজান্তে কিছু দিয়েও থাকি সেটাও আমাকে ঋণী করেছে : গ্রহণ করেছ যতো ঋণী তত করেছ আমায়!

প্রিয় বিদ্যাপীঠের জন্মদিনে নিজের চাওয়া-পাওয়ার ইতিহাসটাই বললাম! ঋণ শোধের ইতিহাস এ জন্মে কোনোদিন লেখা হবে না আমার!

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *