প্রথম পাতা » গল্প » আসমানীর ধলু

আসমানীর ধলু

উপলক্ষ ছাড়া যে লেখা হয়না তা নয়। তবে উপলক্ষ সামনে রেখে লিখলে ব্যাপারটিতে কিছুটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাব আসে। যদিও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কথাটায় কিছুটা নেতিবাচক ভাবের ছিটেফোঁটা আছে। ইতিবাচক-নেতিবাচক মিলিয়েই সবকিছু। যাই হউক, উপলক্ষটা হল কোরবানির ঈদ। অনেকদিন ধরেই কোন কিছুতে মন বসাতে পারি না। লেখালেখিতে তো নয়ই। তাই কোরবানির ঈদ নিয়ে কিছুই লেখা হবে না ধরেই নিয়েছিলাম।

কিন্তু আমার পাশের বাসার গ্যারেজে বেঁধে রাখা একটি বকরীর গত দুই-তিন দিন ধরে একটানা ম্যা-ম্যা ডাক শুনে কিছু একটা না লিখে পারলাম না। ম্যা-ম্যা ডাক আমার লেখার অনুপ্রেরণা। বকরীটাকে ভূষী-কুড়া সবই দেয়া হয়। কিন্তু ম্যা-ম্যা থামে না। দিন রাত সমানে চলছে তার ম্যা-ম্যা। উদর-সর্বস্ব ছাগলটির কাঁঠাল পাতা ছাড়া আর কিইবা চাহিদা থাকতে পারে তা আমার মতো গোশত পছন্দ করা মানুষের বোঝার কথা না। বুঝতে পারলেও তা সুকৌশলে এড়িয়ে যাব বা ভুলে থাকার চেষ্টা করব। এসব পশু-পাখির দুঃখ কষ্ট আমলে নিলে পুষ্টিহীনতায় ভুগবো আমি। আমার ওজন ৬৫ কেজি। উচ্চতা অনুপাতে আন্ডার- ওয়েট আমি। কিন্তু বকরীটার অনবরত ম্যা-ম্যা ডাক আমার অসংবেদনশীল মনকে গলাতে শুরু করল। না, আমি অন্যবাড়ির গ্যারেজে গিয়ে অন্যের কেনা ছাগলটিকে ছেড়ে দেইনি, মুক্ত করে দেই নি। আমার মনে কিছু স্মৃতি জেগে উঠল।

পাকুটিয়া খালের ঐপাড়ে ব্রিজের ঢালেই গোলন নামে এক লোকের বসবাস। হতদরিদ্র বললেও কম বলা হবে। গোলনের কোন ছেলে নাই। দুই মেয়ে। রিনা আর আসমানী। আমি ছোট বেলা থেকেই আসমানীকে খাসি-ছাগল পালতে দেখেছি।ভুষি-কুড়া খাওয়ানোর সামর্থ্য নাই। বিকেলে গলায় দড়ি দিয়ে তিন-চারটা ছাগলকে ক্ষেতে নিয়ে যেত। আইল ধরে ধরে ঘাস খাওয়াত। বাড়িতে একটু আধটু খাওয়াত ভাতের ফ্যান।নিজেরা খেয়ে যদি বাকি থাকত। মাঝেমাঝে ছাগলগুলোকে ছেড়ে দিত। ছেড়ে দেয়ার বিপদ আছে। অন্যের ধানক্ষেতে গমক্ষেতে মুখ দিলেই খোয়ারে। পাঁচ টাকার নিচে ছাড়ন নাই।

খোয়ারী ছিল পাকুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার মান্নু চকিদার। দাপুটে লোক। পুরো ইউনিয়নের নিরাপত্তা কর্মকর্তা ভাবত নিজেকে। তাতে দোষ দেয়ার কিছু নাই।মান্নু চকিদার হাতে লম্বা মোটা বেতের লাঠি নিয়ে চলাফেরা করতো। ক্ষেত খামারের নিরাপত্তার অংশ হিসেবে তার বাড়িতেই খোয়ার। জমির মালিক ধরে ছাগল খোয়ারে দিয়ে আসত আর ছাগলের মালিক অনুনয়-বিনয় করে পাঁচ টাকার জায়গায় দুই টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসত। আর যেন না যায় ক্ষেতে। এরকম হুঁশিয়ারি তো থাকতোই। আমার খাসি পালার অনেক শখ ছিল। কিন্তু এই মান্নু চকিদার আর খোয়ারের ভয়ে সেই শখ খাসির মুখ দেখে নাই।

আসমানিকেও অনেকবার গালি-গালাজ শুনে টাকা দিয়ে খোয়ার থেকে তার ছাগল ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে।এসব ঘটনা কমছে কম বিশ বছর আগের। ২০০০ সালের দিকে বা তার আগে।আর এসব ঘটনা এক বছরের মধ্যেই আটকে থাকে না। এগুলো বরং সময়ব্যাপী ঘটনা, জীবনব্যাপী বললেও ভুল হবে না। আসমানীর ছাগলগুলো হতো একই মা ছাগলের বাচ্চা। তিন চারটা করে বাচ্চা দিত।আস্তে আস্তে ওরা একসাথে বড় হতে থাকে। আসমানী বোতলের মুখে পাটখড়ি লাগিয়ে ফিডারের মত করে ভাতের মাড় খাওয়ায় মাঝেমাঝে। বেশি দরকার হলে দুই টাকা দিয়ে প্লাস্টিকের বোটা কিনে আনত বাজার থেকে। অনেক সময় বাচ্চা দিতে গিয়ে মা ছাগলটি মারা যায়। অনেক কষ্ট করে বাচ্চাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে আসমানী। অন্য বাড়ির আরেক মা ছাগলের সাথে ভাগে জোগে দুধ খাওয়াতে লাগিয়ে দেয় কখনো সখনো।শর্ত একটা বাচ্চা দিয়ে দিতে হবে। আসমানী শর্ত মেনে নেয়। একটা দিলেও দুইটা বা তিনটা তার থেকে যাবে।

এভাবে তিন চারটা ছাগলের বাচ্চা একসাথে বড় হয়। আসমানী বড় করে। কোরবানির ঈদ আসে। বিক্রি করার দিন আসমানীর শোকের মাতম উঠে। বেপারী গলায় দড়ি বেঁধে মায়া মমতার তোয়াক্কা না করে টেনে নিয়ে যায় আসমানীর ছাগলগুলোকে। আসমানী কেন্দে বুক ভাসায়। এই দারিদ্র্যতার মধ্যেও হাতের টাকা তাকে সান্ত্বনা দিতে পারে না।দৌড়ে পিছন পিছন যায় ব্রিজ পর্যন্ত। ডাক দিয়ে বেপারীকে বলে আস্তে আস্তে টাইন্যা ন্যান। এই বলে কাঁঠাল পাতার একটা ডাল দেয় বেপারীর হাতে। ছাগলগুলো যেতে চায় না। যাকে বলে খুট্টী দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বেপারী টেনে নেয়। এভাবে যেতে যেতে হাটে, হাট থেকে মন্টো কালু ধলু একজন থেকে আরেকজন আলাদা হয়ে যায়।আসমানী তার ছাগলের বাচ্চাদের নাম রাখতো। নাম ধরে ডাক দিলেই দৌড়ে আসত। গতরের রঙ দেখেই বেশি নাম রাখতো। ধলু সাদাসাদা রঙের। আমার পাশের বাসার গ্যারেজে ধলু কেন্দে যাচ্ছে। ক্ষুধায় নয়, কালু আর মন্টোকে ভেবে, আসমানীকে না দেখে।

সবার কোরবানি আল্লাহ্‌ কবুল করুক।

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *