আমার গল্পগুলো আর বুঝি বলা হল না! না বলা গল্পেরা ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করে। একটা গল্প শুরু করলে আরেকটা এসে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দেয়৷ তার টা আগে বলতে হবে৷ তাড়া খেয়ে মাথার মধ্যেই গল্প লিখতে শুরু করি। আলমাস আর বাহারামের গল্প। বর্ষাকালে খালে পানি আসলেই দুই ভাই এক সাথে ব্রিজের উপর থেকে লাফ দিয়ে দিয়ে খালের পানিতে লম্বা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম। এই বুঝি একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। পানির নিচে বাশঁটাশ কিছু একটা থাকতে পারে যে! কলাগাছ কেটে ভেলা বানাতে দুই ভাইয়ের জুড়ি ছিল না৷ ওদের বানানো ভেলায় আমাকে চড়তে দিত৷ আমি ধন্য হয়ে যেতাম৷ আমার ভেলা বানানোর মুরদ ছিল না৷ ভাটিতে খালের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ভেসে যেতাম৷ উজানে ফিরতে অনেক ওস্তাদি করতে হত৷ আলমাস আর বাহারাম লগি চালনায়ও ওস্তাদ৷ আমি ব্যস্ত থাকতাম ডাইনকিনা মাছ ধরতে৷ কলাগাছের ভেলার ফাঁক দিয়ে ডাইনকিনা মাছ লাফিয়ে ভেলায় উঠত৷ আমি হুটোপুটি করে ওদের ধরতাম৷ একটা পলিথিনের ব্যাগে পানি ভরে ওদের রেখে দিতাম৷ ভেলা থেকে নেমে আমাদের বাড়ির পাশের ছোট্ট ডোবাটায় ছেড়ে দিয়ে মাছের চাষ খেলা খেলতাম৷ এই ডোবা পুকুর আমার৷ মাছের পোনা ছেড়ে দিলাম৷ মাছ বড় হলে ঘের জাল দিয়ে ধরে পাকুটিয়া হাটে বিক্রি করব৷ সকালে পোনা ছেড়ে বিকেলে এসে খবর নিতাম মাছ কত বড় হল!
এক সময় বিয়েথা করে দুই ভাই। কিন্তু বেশিদিন সংসার করতে পারে না আলমাস। দড়গ্রামের মোকাম থেকে সাইকেলে করে কাঠফাটা রোদে আলু পটল আর কাঁচামরিচের বোঝা আনতে গিয়ে রাস্তায় মরে পড়ে থাকে। মরার বছর তিনেক আগে থেকে হলুদ কাপড় পরিধান করা শুরু করেছিল আলমাস। গভীর রাতে আলমাসদের বাড়ি থেকে শিয়ালের বাচ্চার কান্নার মতো আলমাসের কান্নাকাটির আওয়াজ পাওয়া যেত। ওর কাছে নাকি জ্বীন আসা যাওয়া করে। এদিকে আলমাস মরার পরে ছোট ছোট দুই মেয়ে নিয়ে অথই সাগরে পড়ে আলমাসের বউ। বাহারাম বেশ আছে। বাজারে চায়ের দোকান। রমরমা ব্যবসা। এই এলাকার মানুষ ভাত না খেয়ে থাকতে পারলেও চা না খেলে চলে না।
মজ্ঞা পাগুল্লির গল্প এসে এখন আবার মাথায় চাপতে চাইছে। তার গল্পই নাকি বলতে হবে এখন। ওই দিকে রাসু গাছি খেজুরের রসের হাড়ি নামাচ্ছে গাছ থেকে। সেও বলে রেখেছে তার গল্পটা বলতে হবে। এভাবে একটা গল্প লিখতে শুরু করলে অন্যগুলো এসে হুমড়ি খেয়ে পড়তে চায়। সবাই চেপে বসে মাথায়। কিন্তু আমার কারও গল্পই বোধহয় বলা হবে না৷
শুক্রবার হাটবার। মজ্ঞা পাগুল্লি একটা লোহার মরিচাধরা থালা হাতে হাটের ভিটায় ভিটায় ঘুরে সদাই জোগাড় করে। ওর দুই হাতের কুনুই পর্যন্ত রঙ বেরঙের লোহার আর কাঁচের চুড়ি৷ মাথার চুলে নানা রঙের কাপড়ের টুকরা বাধা৷ জামাল খলিফা আর নেদু খলিফার দোকান থেকে ফেলে দেয়া কাপড় টুকিয়ে টুকিয়ে তার এই কান্ড৷ চুল দেখা-ই যায় না৷ বাতাস এলে কাপড়ের ফিতাগুলো এলোমেলোভাবে উড়তে থাকে৷ তাকে দেখে তখন বেশ ভয়ংকর আর অশরীরি লাগত৷ মনে হত এই বুঝি আকাশে উড়ে যাবে৷
মজ্ঞার থালা সদাইপাতিতে ভরে গেলে বটগাছের গোড়ায় লুকিয়ে রাখা প্ল্যাস্টিকের বস্তায় ঢেলে রাখে। আবার চক্কর দিতে শুরু করে হাটের দোকানে দোকানে। যে যা বিক্রি করছে সে তাই অল্প অল্প করে তুলে দিচ্ছে থালায়। সব মাখামাখি হয়ে যায় থালায় আর বস্তার ভেতরে। মজ্ঞা পাগুল্লির বাড়ি রাথুরা গ্রামে। পাটখড়ির ঘরে বসে অনেক রাত অবধি বাছাবাছি করে সব আলাদা করে রাখে। সোমবার যাবে আবার চাচিতারা হাটে।
পরাণ পাগলার মা-ও থালা নিয়ে হাটে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু মজ্ঞার সাথে পেরে উঠে না। মজ্ঞার বস্তা ভরে যায়। আর পরানের মায়ের বাঁশের টুকরিও ভরে না। কারণ হল পরাণ৷ পরাণও তোলা নেয়৷ বেপারীদের কাছ থেকে তুলেতুলে সদাইপাতি নেয়াকে তোলা উঠানো বলে৷ বেপারীরা বিরক্ত হয়ে পরাণের মাকে বলে, মায়েরেও দিতে অইব আবার ছেলেরেও দিতে অইব, তাতো আমরা পারব না বইন, পরাণ তোলা নিয়ে গেছে, তোমারে দিতে পারব না পরাণের মা, মাফ করো৷
সকাবেলা আবার মুক্তার পাগলা সাইকেলের খেলা দেখিয়ে গেছে। সাইকেল নিয়ে তার কত রকমের কসরত। সাইকেলের সিটে দাঁড়িয়ে সাইকেল চালায় সে। আরও কত কায়দা। জমিদার বাড়ির মাঠে দাঁড়িয়ে আমরা পোলাপাইনরা অবাক হয়ে দেখি। কেউ কেউ আবার মুক্তার পাগলার সাইকেলের পেছনে পেছনে হইহই করে দৌড়াতে শুরু করে৷ বড়রাও দেখে৷ সে কি উত্তেজনা। আমি নিজে নিচ দিয়ে সাইকেল চালাই। সিটে বসে পেডাল নাগাল পাই না। বড় হয়ে আমার মুক্তার পাগলার মতো সাইক্লিস্ট হতে ইচ্ছা করে।
মামু পাগলার কথাও বাদ দেয়া যায় না। এ যেন পাগলের হাটবাজার। মামু পাগলা কবে কোনদিন পাকুটিয়া এসে আস্তানা গেঁড়েছে কেউ বলতে পারে না। খাবার দিলে খায় না, শুধু চা খায়। ইচ্ছা হলে একটু আধটু ভাত চেয়ে খায়। সারা রাত জমিদার বাড়ির বারান্দায় শুয়ে থাকে। মাঝেমাঝে বসে বসে ঘাস ছিঁড়ে ঢিপি বানায়। সকালবেলা ঢিপির পাশে হাগু পাওয়া যায়। ঢিপি বানিয়ে হাগু করে মামু পাগলা। পাগলের কান্ড! মামু পাগলার নাম মামু কিভাবে হল কেউ জানে না। মামু বলে ডাকলে ইশারা ইঙ্গিতে উত্তর দেয়। প্রথম দিকে মামু পাগলাকে পুলিশের চর ভাবত কেউ কেউ। চেহারা ফর্সা, নাক খাড়া। লম্বা চুল, লম্বা দাড়ি। চেহারায় বড় ঘরের ছাপ আছে। বছর পাঁচেক হয়েছে মামু পাগলা মারা গিয়েছে। রাসু গাছি, মুক্তার পাগলা আর মজ্ঞা পাগুল্লিরাও আর বেঁচে নেই। কিন্তু ওদের গল্প ওরা বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে, আমার উপর ভর করে। গল্পের ভারে আমি ন্যুজ। গল্পগুলো বলা হবে না।
শীতকাল এলেই রাসু গাছির ব্যস্ততার অন্ত থাকে না৷ পেত্নিপাড়া, বইন্যাপাড়া, দিঘুলিয়া আর চাচিতারা থেকে ফরমায়েশ আসতে থাকে৷ খেজুর গাছ কাটতে হবে৷ হাড়ি বসাতে হবে৷ গাছপ্রতি ৫ টাকা৷ লুঙ্গি কাছা দিয়ে তরতর করে খেজুর গাছে উঠে যায় রাসু গাছি৷ দাঁত দিয়ে ধরা থাকে ধারালো দা৷ দুলাল কামারের কাছ থেকে শান দিয়ে রেখেছে৷ গাছের ডালপালা কেটে আর গলা কামিয়ে হাড়ি ঝুলিয়ে দেয়৷ বাঁশের চুঙ্গা লাগায়৷ চুইয়ে চুইয়ে রস পড়ে হাড়িতে৷ সারা রাত ধরে৷ নিপাহ ভাইরাসের কথা রাসু গাছির অজানা৷ আমরাও জানি না৷ সকালে উঠে খালি পেটে খেজুর রস খেতাম৷ পেত্নিপাড়া গ্রাম থেজে মান্নান ভাইয়ের বাপ আসে খেজুর রস বিক্রি করতে৷ এক টাকা গ্লাস৷ আধসেরি এলুমিনিয়ামের গ্লাস৷ মান্নান ভাই এখন সেনাবাহিনীতে চাকরি করে৷ বাপ আর খেজুর রস বিক্রি করে না৷ টাকার জন্য যে খেজুর রস বিক্রি করত তা না৷ খেজুর রস বিক্রি করেই সংসার চালাতে হয় সেরকমও কিছু নয়৷ গ্রামের মানুষ নিজে খেয়ে যা বাকি থাকে তা বিক্রি করে দেয় মনের আনন্দে৷ দুই এক টাকা কম বেশির চিন্তা করে না৷ উৎপাদনেই বেশি আনন্দ, বিক্রি করে দুই চার টাকা লাভ করার চিন্তা খুব কমই কাজ করে৷
হলুদ পাঞ্জাবি আর হলুদ পাগড়ি মাথায় দিয়ে খোলা লবণ বিক্রি করছে আজমত বেপারি। সে পীর বংশের ছেলে। সব সময় হলুদ জামা কাপড় পরিধান করে। এক কেজি করে লবণের পুটলা বানিয়ে থরেথরে সাজিয়ে রাখছে। গরুর লবণ আর মানুষের লবণ আলাদা। গরুর লবণ ৫ টাকা কেজি আর মানুষেরটা ৭ টাকা। মানুষের খাওয়ার লবণ একটু বেশি সাদা৷ গরুরটা কালচে৷
ননী বনিক্কি নানা ধরনের ঔষুধী ফল আর গাছের বাকল নিয়ে বসে আছে। প্রাণ গোপাল তার ছেলে। আরও দুই ছেলে আছে। কৃষ্ণ আর হারাধন। প্রাণোর মুদির দোকান পাশেই। বাজারের সবাই তাকে প্রাণো বলেই ডাকে। অনেকেই রসিকতা করে ও প্রাণ বন্ধুরে বলে ডাকে৷ ননী বনিকের ভিটির দোকান থেকে আমার আব্বা ত্রিফলা কিনে আনত। আমলকী, হরিতকি আর বহেরা, তিনে মিলে ত্রিফলা। রাতে ভিজিয়ে রেখে সকাল বেলা খেতে হত। আব্বা জোর করেই খাওয়াত। খেতে তিতা আর বিস্বাদ। কিন্তু উপকার অনেক। দেহ থেকে সব বিষাক্ত জিনিস বের করে দেয়। প্রাকৃতিক ডিটক্স। ননী বনিক কবে কোন দিন মারা গেল মনে নাই। আমরা দাদা বলে ডাকতাম। বনিক্কি দাদা৷ আর তার ছেলে প্রাণো কে কাকা। প্রাণো কাকাও বদলে গেছে, ভেতরে নয় বাইরে৷ অনেক আগে চোখের এক কোণে শ্বেতী রোগের লক্ষন দেখেছিলাম৷ এখন তা সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে৷ এক ইঞ্চি জায়গাও বাদ নাই৷ মানুষ হিসেবে যে কি ভালো এই প্রাণো কাকা তা আমার পক্ষে বলে বুঝানো সম্ভব নয়৷ স্বল্পভাষী আর সৎ৷ ওজনে কম দেয়ার ব্যাপারে বাজারের দুই একজনের বদনাম ছিল৷ কিন্তু প্রাণো কাকা আর ভগন কাকার ব্যবসায়ীক সুনাম সুদূর দ্বিমুখা বাজার পর্যন্ত প্রসারিত৷ বান্ধা খরিদ্দারের অভাব নাই তাই৷ ছটাকে দুই টাকা কম দিলেও এসব কাস্টমারের কেউ অন্য দোকানে নারিকেল তেল কিনতে যায় না৷ আগে গ্রামে গঞ্জে ছটাক হিসেবে তেল বিক্রি হতো৷ এখন খোলা তেল বিক্রিই হয় না বলা যায়৷ যাহোক, যে শ্মশানঘাটে ননী দাদার শেষকৃত্য হয়েছিল তার পাশ দিয়ে আমি টাংগাইল যাওয়া আসা করি। আসা যাওয়ার পথে মলিন ধুতি আর গেঞ্জি পড়া ননী দাদার কথা মনে পড়ে যায়। আর মনে পড়ে সকালে বাসি পেটে ত্রিফলা খাওয়ার ইতিহাস।
ভগন কাকার কথা না বললেই নয়৷ ইনার আসল নাম ভগবান৷ লোকমুখে হয়ে গিয়েছে ভগন৷ আমি আমার আব্বাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, ভগন কাকাই কি হিন্দুদের ভগবান? ভগন কাকা আর রাম কাকা দুই ভাই৷ একটা মুদির দোকান দুই ভাই মিলে চালায়৷ বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি৷ এখনও ঠিক তাই আছে৷ রাম কাকা ক্যাশ বাক্সে বসে আর ভগন কাকা মাপামাপি, প্যাকেট করা এসব করে৷ ভগন কাকার দোকানে পাকা তেঁতুল বিক্রি করত৷ এক টাকায় দুই ছড়া দিত৷ আমি লবণ মাখিয়ে হাতে নিয়ে চুচু করে খেতাম আর বাজারে ঘুরে ক্যানভাসারদের জাদু দেখতাম৷ তিন চারজন জাদুকর আসত পাকুটিয়া বাজারে৷ জাদু দেখতাম আর ভাবতাম, ইশ জাদুটা যদি ধরতে পারতাম তাহলে দেখিয়ে দিতাম! এখন ধরতে পারার জ্ঞান হয়েছে কিন্তু দেখিয়ে দেয়ার আহাম্মকি ভাবটা আর নাই৷ থাকার কথাও না৷ ছোটবেলার ভাব বড় হওয়ার পরও থেকে গেলে বিপদ৷ জাদুকরেরা বিনয়ের সাথে শুরুতেই তাই বলে নেয়, দয়া করে কেউ পেটে লাথি দিবেন না৷
হাটের সবচেয়ে বড় কাঁঠাল গাছটার নিচে কাঠের পিঁড়ি পেতে সার করে বসে আছে চাচিতারার নাপিতেরা। ইটের উপর বসিয়ে চুল কাটছে আর দাড়ি কামাচ্ছে। আব্বা আমাকে আর আমার ভাইকে নিয়ে যেত সাধন নাপিতের কাছে। পাটখড়ির মতো শুকনো দুই হাটুর ফাঁকে মাথা নিয়ে স্কয়ার কাট বসিয়ে দিত সাধন নাপিত৷ চিমটি দিয়েও চুল ধরার উপায় নাই। ন্যাড়া করলেই পারত! চুল যত ছোট করে কাটবে, বড় ততো পরে হবে। বেশিদিন যাবে। ঘনঘন টাকা লাগবে না। ছোট করে কাটলে আমি খুশিই হতাম। সাধন নাপিতের হাটুর ওই ইঁদুরের যাতাঁকলে যত কম বসা যায় ততই ভাল। এখন আমি চুল কাটাই আকতার আলী হেয়ার স্পেশালিস্ট এর কাছে। ধানমন্ডি ৯/এ তে, মীনা বাজারের উপরে। আকতারের কাছে বিরাট কোহলি থেকে শুরু করে শহিদ আফ্রিদিরা চুল কেটেছে। আমি ওরকম গোছের কেউ না। তবে একেবারে কাঁঠাল গাছের তলা থেকে কোহলিদের পর্যায়ে উঠে গেছি বলা যায়৷ ভাভাগো ভাভা! এভাবেই সব কিছু বদলে গেছে, সব কিছু বদলে যায়৷ শুধু গল্পগুলো না বলা-ই থেকে যায়।