প্রথম পাতা » গল্প » আমার ইশকুল

আমার ইশকুল

my school

আমাদের পড়ালেখার সিস্টেমে প্রথম ডিসিশন নেয়ার সময় আসে ক্লাস নাইনে উঠার পর। সায়েন্স নিব, আর্টস নিব না কমার্স নিব- এটাই হয়ে যায় জীবনের একমাত্র প্রশ্ন। যদিও বেশীর ভাগ সময়ে ছাত্র ছাত্রী থেকে তাদের অভিভাবকদের ডিসিশন মূখ্য হয়। কার কি পড়তে ভাল লাগে, কার কতটা মেধা আছে তার চাইতেও অভিভাবকদের স্ট্যাটাস সিম্বল প্রাধান্য পায় বেশি।

আমার ক্ষেত্রে অবশ্য এই ঘটনা ঘটে নি, আমি নিজে ইচ্ছা করে, নিজ বুদ্ধিতে সায়েন্স নেই। কি পড়তে হবে, কতখানি পড়ালেখা করতে হবে, মেইন সাবজেক্ট কি নিব, ফোর্থ সাবজেক্ট কি নিব এমনকি কোন কোন সাবজেক্ট পড়তে হবে এই সম্পর্কে কোন প্রকার কোন ধারণা ছাড়াই। এখন কি হয় জানিনা কিন্তু সে সময় সায়েন্স পড়ুয়াদের ভাল স্টুডেন্ট হিসেবে গণ্য করা হত। কাজেই যেহেতু সায়েন্স নিয়েছি আমারও নিজের মধ্যে একটা ভাল স্টুডেন্ট – ভাল স্টুডেন্ট ভাব চলে আসলো। নিজেকে বেশ মেধাবী(!) মনে হত। অন্য গ্রুপের চাইতে নিজেকে বেশ অভিজাত বলে জাহির করতে মন চাইত। পড়ালেখা করার চেয়ে ভাব নেয়াটাই যেন বেশি গুরূত্বপূর্ণ! পড়ে আর কি হবে! সায়েন্স নিয়েছি, ওতেই তো আমি ভাল স্টুডেন্ট!

ভাবে ভাবে দিন যায়, মাস গড়ায়। ফিজিক্স-কেমিস্ট্রর খ্যাটখ্যাটানির চাইতে তিন গোয়েন্দা-মাসুদ রানার আকর্ষণ অনেক বেশি। আরো একটা জিনিস পড়তে ভাল লাগত, সহপাঠ। হায়ার ম্যাথ-জেনারেল ম্যাথ, এক্স, ওয়াই, জেড হ্যান ত্যান জটিল সম্পর্কের সমাধান বের করার চাইতে টুনি-মন্টুর পরকিয়া প্রেমের সম্ভাব্য সমাধান বের করা অনেক বেশি সহজ!

ফাঁকিবাজি করতে করতে দিন যায়, মাস গড়ায়।

প্রথম সাময়িক পরীক্ষা আসার আগেই আমার সহপাঠ বই ছিড়ে ঝাঝরা। অন্যদিকে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, হায়ার ম্যাথ সহ অন্যান্য বই ঝকঝকে তকতকে। কোন কোন বই খুললে নতুন বইয়ের গন্ধ পাওয়া যায়! ফলাফল-প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় কেমিস্ট্রিতে এগারো, বায়োলজিতে তেরো, ফিজিক্সে টেনেটুনে পাস- বিশ, হায়ার ম্যাথে একশতে একুশ, জেনারেল ম্যাথে সাড়ে ৩৯! অর্থাৎ তিনটা সাবজেক্টে ভালোমতন ফেল আর দুইটা সাবজেক্টে প্রায় ফেল।

ব্যস! ভাব এবং আভিজাত্যের আকাশে বাতাসে উড়তে থাকা আমি ধপাস করে মাটির পৃথিবীতে!

জীবনটা যেন ডেমরা ঘাটের ধূলা-বালির চাইতেও মূল্যহীন! বাসায়, স্কুলে, দুনিয়ার সব জায়গায় কেবল বকা আর উপদেশ। উপদেশ আর বকা। রঙ্গিন চশমা পড়ে দেখা দুনিয়াটা সাদাকালো হয়ে গেল। সে এক মহা দুঃখময় জীবন। বাসায় বকা, স্কুলে বকা। মাঝে মাঝে উত্তম-মধ্যমও জোটে কপালে। ফেলের খাতা বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর অনেক চেষ্টা করি কান্নাকাটি করে একটু সমবেদনা আদায় করতে, কেন যেন চোখে পানিও আসে না! বুঝতে পারলাম, বেঁচে থাকতে হলে একটু পড়ালেখা করতে হবে! নতুবা এই বকাসমৃদ্ধ বা উপদেশময় জীবন রেখে কোন লাভ নেই! বছরের চার-পাঁচ মাস পর প্রথম পড়ালেখা শুরূ করি। দীর্ঘ অনভ্যাসে কিছুই মাথায় ঢুকতে চায় না প্রথমে। কি কি সব বিদঘুটে জিনিস! পড়তে ভালো লাগে না। গল্পের বই পড়তে ইচ্ছা করে। ছবি আকতে মন চায়। তারপরও বই নিয়ে বসি। হায়ার ম্যাথ করার চেষ্টা করি। ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির খটমটে জগতে উঁকিঝুঁকি মারি।

দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা এগোয়। যথা সময়ে পরীক্ষা হয়, খাতা দেয়। এবার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও খুব বেশি না। ফিজিক্সে আর জেনারেল ম্যাথে ভালোভাবেই পাস, হায়ার ম্যাথে টেনেটুনে পাস-৪১। কেমিস্ট্রিতে আর বায়োলজিতে আবার ফেল। এবার তো আমার মাথায় হাত! এরকম হলে তো আমি ক্লাশ টেনে উঠতেই পারব না! ক্লাশ নাইনে দুই বছর থাকতে হবে! তার চাইতে তো গলায় দড়ি দেয়া সহজ!

এতদিন অনুভূতি ছিল ভয়, লজ্জা, মন খারাপ ভাব এইসবের। এখন সেই সাথে আরেকটা অনুভূতি যোগ হয়। তা হল আতঙ্ক। যেখানে ২০ পেয়ে আমি পাসই করতে পারি না সেখানে কেমিস্ট্রি আর বায়োলজিতে আমাকে ৩০ এর কাছাকাছি পেতে হবে! আর হায়ার ম্যাথে ৫৮। ব্যপারটা এককথায় প্রায় অসম্ভব। চোখে মুখে অন্ধকার দেখি। তারপর বুঝলাম, মানে প্রথম মাথায় ঢুকলো যে চোখে মুখে অন্ধকার দেখে লাভ নেই বরং বই পত্র নিয়ে বসলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। অন্যথায় ক্লাশ নাইনে দুই বছর থাকা প্রায় নিশ্চিত।

এবার আমি ভালোভাবে পড়তে বসি। দিনরাত পড়ি। পড়ি, ম্যাথ করি, ভুলে যাই, আবার পড়ি। কেমিস্ট্রির লম্বা লম্বা সমীকরণ কিছুতেই মাথায় ঢুকতে চায় না। বায়োলজি মুখস্ত হয় না। তবুও পড়ি। মাঝে মাঝে কান্না পায়, মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা করে। কেন যে সায়েন্স নিলাম! তার জন্য এই অবস্থা! দিন যায়, মাস গড়ায়। তৃতীয় সাময়িক পরীক্ষা দিলাম। আমি মোটামুটিভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নেই ক্লাশ নাইনে দুই বছর থাকার জন্য।

যেদিন রেজাল্ট দেয়ার কথা সেদিন অনেক সাহস নিয়ে স্কুলে গেলাম। অনেকেই ফেল করে, দুবছর এক ক্লাশে থাকে, আমিও নাহয় থাকব- নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম। যখন স্যার আমাদের ক্লাসের রেজাল্ট পরা শুরু করলেন আমার কান তখন ভোঁ ভো। প্রথম দিকে কিছুই শুনতে পারছিলাম না। অবশ্য প্রথম দিকে আমার রোল থাকবে এমন আশা আমি দুঃস্বপ্নেও করিনি। যাইহোক, রোল বিশ পর্যন্ত ডেকে ফেলার পর আমি শোনা শুরু করি এবং তারপর শেষ অবধি মন দিয়ে শুনে নিজের নামখানা কর্ণগোচর করতে ব্যর্থ হই। তারমানে ফেল। দুই বছর ক্লাশ নাইন।

ফ্যাকাশে-রক্তশূন্য মুখ নিয়ে যখন এদিক ওদিক তাকাচ্ছি তখন কে যেন বলল, “তুই তো অনেক ভাল করেছিস।” মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। এটা কোন কথা! ফেল করেছি, আমার নামই ডাকেনি আর আমাকে কিনা বলে অনেক ভাল করেছি! তখন আশপাশের কথা বার্তা থেকে যা শুনলাম তা হল আমার নাম নাকি অনেক আগেই ডেকে ফেলেছে। অর্থাৎ আমার ভোঁ ভোঁ সময়ে। ধুর! বিশ্বাসই করলাম না! এটা কি সম্ভব নাকি! হতেই পারে না! কিছুক্ষণের মাঝেই রেজাল্ট কার্ড হাতে পেয়ে গেলাম। দেখে আমার চক্ষুচড়ক-গাছ। এও কি সম্ভব! মাত্র চৌদ্দজন সব সাবজেক্টে পাস করে নাইন থেকে টেনে উঠেছে আর আমার রোল হয়েছে চৌদ্দ! তার মানে আমি কেমিস্ট্রি আর বায়লজিতে ৩০ এর কাছাকাছি পেয়েছি, হায়ার ম্যাথে ৫৮! তার মানে পড়ালেখা করলে এর ফল পাওয়া যায়! আহ! কি শান্তি! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! আমি এখন ক্লাশ টেনে পড়ি!

যদি ভেবে থাকেন এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি ক্লাশ টেনে উঠে নিয়মিতভাবে পড়ালেখা শুরু করেছি, ভুল করছেন। আকাশে বাতাসে আনন্দ নিয়ে ক্লাশ টেনে উঠে আমি আবার আগের মতই ফাঁকিবাজ হয়ে যাই। ক্লাশ টেনের প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় আমি অতীব সফলতার সাথে হায়ার ম্যাথ এবং ফিজিক্সে ফেল করি। তবে এবার কেন জানি আর এত ভয় লাগে নি। ক্লাশ টেনে তো উঠেই গিয়েছি, এখন তো আর কেউ নাইনে নামিয়ে দিতে পারবে না! মেট্রিক পরীক্ষা তো দিতেই পারব!

ততদিনে সায়েন্সের কচকচানি একটু সহ্য হয়ে এসেছে। পড়তে ভালো লাগে না এইসব হাবিজাবি কিন্তু পড়ার একটা অভ্যাস দাঁড়িয়ে গিয়েছে। প্রি-টেস্ট, টেস্ট পরীক্ষায় আর ফেল করতে হয় নি। এবং মেট্রিক পরীক্ষায়ও আর ফেল করিনি ! ৪.৯৪ পেয়ে এক চান্সেই পাস করেছি! একটুর জন্য এ+ মিস হবার জন্য সবাই অনেক আফসোস করলেও আমি ছিলাম মহা খুশি। যাক বাবা! ফেল তো করিনি! ওই অনেক! আর এ+ পাইনি এই অজুহাতে সায়েন্স ও নিতে হবে না!

হে সায়েন্স, তোমায় আজকে দিলাম ছুটি;
সায়েন্সের রাজ্যে পৃথিবী ফেলময়,
কেমিস্ট্রির বই যেন তিতা করল্লা!

তবে মজার বিষয় হল এই যে, সায়েন্স বাদ দিয়ে কমার্স নিয়েও আমি কলেজের প্রথম পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে এক সাবজেক্টে ফেল করি! কমার্স নিয়েও আমি যথেষ্ট নাকানি চুবানি খাই। সে গল্প নাহয় আরেকদিন ……

এখন যে কথাটা বলতে ইচ্ছে করছে তা হল, জীবনে যতবার কোন সমস্যায় পড়েছি, যতবার মনে হয়েছে এই বাধা আমি অতিক্রম করতে পারব না তখনই আমার মনে হয়ে যায় আমি সব সাবজেক্টে পাস করে নাইন থেকে টেনে উঠেছিলাম। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা, পরিশ্রম দিয়ে সাফল্য পেয়েছিলাম। তখন যেহেতু পেরেছি, চেষ্টা করলে সবসময়ই পারব। ক্লাশ নাইনে পড়া ছোট্ট মেয়েটা যদি সেই বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে পারে, প্রায় অসম্ভব একটা বিষয়কে আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারে তাহলে যে কেউ যেকোন পরীক্ষায় পরিশ্রমের মাধ্যমে সাফল্য পেতে পারে।

ওই ফেল, ওই অকৃতকার্য হওয়া আমার জীবনের এক আশির্বাদ, এক মহান শিক্ষা। স্কুল পরবর্তী জীবনে আমি যা যা পেয়েছি তাতে আমার কোন অতৃপ্তি নেই। বরং যা চেয়েছি তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি পেয়েছি। এই পাওয়ার পেছনে পরিশ্রম, চেষ্টা যেমন ছিল, ঠিক তেমন ছিল নিজের উপর বিশ্বাস। যা আমি পেয়েছিলাম স্কুল জীবনের ফেল থেকে। স্কুল জীবনে করা ফেল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা!

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

রোকসানা বিন্তী
উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক৷

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *