টিফু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে সাভার থেকে ঢাকা যাচ্ছে। উদ্দেশ্য বইমেলায় ঘুরে বেড়ানো কিন্তু বই না কেনা। পকেটে টাকা নাই। দুই টাকা ভাড়া দিয়ে ক্যাম্পাসের বাসে যাচ্ছে। ফিরবেও এই বাসেই। পকেটে টাকা থাকলেও টিফু বই কিনত না এবারের বইমেলা থেকে। পাঠকের চোখে বইমেলা সে আর দেখতে চায় না। এবার যাচ্ছে লেখকের চোখ নিয়ে। টিফু বই লিখবে। সামনের বইমেলায় বই বের করবে। এক বই দিয়েই সে জনপ্রিয় হয়ে যাবে। পাঠকেরা তাকে ঘিরে ধরে বইয়ের পাতায় অটোগ্রাফ নেবে। লেখক লেখক ভাব নিয়ে প্রকাশনার স্টলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকবে। পাঠকদের বই নেড়েচেড়ে দেখা উপভোগ করবে। তারা তাকে নিয়ে কানাকানি করবে। টিফু এসব কল্পনা করে অনেক আনন্দ পাচ্ছে বাসে বসে। বাস জ্যামে আটকে আছে সাইন্সল্যাবে। প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে গেল। আজকে শুক্রবার। একটু পরেই মাগরেবের আযান শুনা যাবে এলিফ্যান্ট রোডের মসজিদ থেকে। টিএসসিতে যেতে যেতে বইমেলার গেট বন্ধও হয়ে যেতে পারে। রাত নয়টা পর্যন্ত মেলা।
নীলক্ষেত মোড়ে এসে টিফু বাস থেকে নেমে পড়ে৷ তেঁতুল গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষন। কিছুদিন আগে আগুন লেগে অনেক বইয়ের দোকান পুড়ে গেছে। দুই একটা পোড়া বই এখানে সেখানে পড়ে আছে। রাস্তার পাশের বইয়ের দোকান দেখতে দেখতে টিফু বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের কাছে চলে এলো। হেটেহেটেই যাবে টিএসসি পর্যন্ত। তারপর টিএসসির পাশের গেট দিয়ে ঢুকে যাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। নিউমার্কেট থানার পাশের পুরাতন বইয়ের দোকানের সামনে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে কিছু বই উলটে পালটে দেখে৷ শ্রীপান্থের ঠগী আর হারেম বই দুইটা কিনবে কি না তা নিয়ে দোলাচল করে আর কেনা হয় না। পকেটে যা টাকা আছে তা শেষ করে ফেলা উচিত হবে না।
টিএসসিতে মানুষের মেলা। মানুষ বইকে কত ভালোবাসে ভেবে টিফু অনেক পুলকিত হয়। বই না ভালোবাসলেও মেলা সবার পছন্দ তাতে সন্দেহ নেই। বইপ্রেমিকের সংখ্যা এতো হতে পারেনা। টিফু এই ব্যাপারে নিশ্চিত। ভিড় ঠেলে গেট দিয়ে মেলায় ঢুকে যায় টিফু। গেটে পুলিশ দাঁড়িয়ে মাস্ক আছে কিনা চেক করছে। মাস্ক বিক্রেতারা চিৎকার করে বলছে, মেলার ভেতরে মোবাইল কোর্ট আছে। মাস্ক কিনে নিয়ে ঢুকেন। টিফু মেলার ভেতরে কোন মোবাইল কোর্ট দেখতে পেলনা। মাস্ক বিক্রি করার কৌশল।
মেলায় ঢুকেই এক কাপ কফি খায় সে। পনেরো টাকা দাম। পকেটে টাকা না থাকলেও কফি খাওয়া লাগবেই তার। কফি না খেলে তার মাথা আউলা হয়ে থাকে। কফি শেষ করে টিফু যায় ঘাসফুল প্রকাশনার স্টলে। নতুন লেখকদের বই পাওয়া যায় এখানে। ইদানিং সে মনে করে নতুন লেখকদের লেখা বই বেশি করে পড়া উচিত। না পড়ে আগে থেকেই কিছু উড়িয়ে দেয়া উচিত না।
এখন নাকি সবাই লেখক। পাঠকের চাইতে লেখক বেশি। প্রকাশনার সংখ্যাও দিনদিন বেড়েছে অনেক। কিছু প্রকাশনা থেকে চাইলেই টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করা যায়। টাকা দিয়ে বই প্রকাশ অপরাধ মনে করে না টিফু৷ মানহীন বই দিয়ে পাঠক ঠকানো অপরাধ৷ এরকম কয়েকটা প্রকাশনার কিছু বই টিফু পড়েছে। অসংখ্য বানান ভুল আর লেখার মধ্যে গভীরতা ও আন্তরিকতার বালাই নাই। লেখক নিজেই জানে না সে কি লিখতে চাচ্ছে। সমালোচনা করার মতো জ্ঞান টিফুর নাই। তবে ভালো মন্দের ব্যাপারে একটা ধারণা তার আছে। মন্দ লেখকও এক সময় ভালো লেখক হয়ে উঠতে পারে যদি তার মধ্যে নিজেকে প্রতিদিন নিজেই ছাড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আর প্রবণতা থাকে। আর ভালো পাঠক না হয়ে ভালো লেখক হওয়া যায় না। এই কথা মানার ইচ্ছাও থাকতে হবে। অধিকাংশ নতুন লেখকের মধ্যে এই ইচ্ছা নাই। তবে,কিছু কিছু নতুন লেখকের মধ্যে আঁচ করা যায় সৃষ্টির প্রতি আন্তরিকতা, সততা আর মানদণ্ডের বিচার। এদের সংখ্যা খুব কম। সবাই দন্ড পছন্দ করে না৷ উত্তর-আধুনিক যুগ দন্ডের ধার ধারে না৷
লেখকের চোখ নিয়ে মেলায় এসে টিফুর জ্ঞান অনেক বেড়ে গেছে বলে তার মনে হতে লাগলো। টিএসসি গেট, বাংলা একাডেমি গেট, ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট গেট সংলগ্ন সব স্টল ঘুরে টিফুর মনে হল, কত শত প্রকাশনা! সব প্রকাশনার নিজস্ব চরিত্র রয়েছে। সবাই সব বই প্রকাশ করে না। অধিকাংশ প্রকাশনার মূল চিন্তা প্রকাশিত বইটি ভালো বিক্রি হবে কিনা ! পাঠকের চাহিদা, রুচি, প্রবণতা এসব বিচার করে বই প্রকাশ করা হয়। চিন্তায় রাখতে হয় বিভিন্ন শ্রেণির পাঠকের কথা। শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে কম শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, বেশি শিক্ষিত সবার কথাই বিবেচনা করতে হয়।
টিফু এমন একটা বই লিখবে যা সব প্রকাশকরা প্রকাশ করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে। পাণ্ডুলিপি পড়েই প্রকাশকরা যা বুঝার বুঝে ফেলবে। এই বই বাজারে কাটবে অসাধারণ। এমনভাবে লেখা যে সকল শ্রেণির পাঠক বইটি লুফে নেবে। লেখকের তারিফ না করে পারবে না। লেখা, লেখক, প্রকাশনা আর পাঠকের জগতের গোপন মন্ত্র এই নতুন লেখকের হাতের মুঠোয় বন্দি। লেখক খুব ভালোভাবেই জানে প্রকাশকরা কি ছাপাবে আর কি ছাপাবে না, পাঠকেরা কি পড়বে আর কি পড়বে না। এই রসায়ন সব লেখকের জানা নাই। টিফু জনপ্রিয় লেখক হতে চায়। জনপ্রিয়তার সাথে কালজয়ী হওয়ার কোন বাদানুবাদ নাই। সে তাই মনে করে।
টিফু জনপ্রিয়তা, পাঠকপ্রিয়তা ও প্রকাশকপ্রিয়তার সাথে সাহিত্যের মূলকথা এমনভাবে বেঁধে বই লিখবে যে তার জীবনের সকল অ-ভাব কেটে যাবে। অর্থের অভাব, খ্যাতির অভাব, যশের অভাব আর শান্তির অভাব। মানুষ ও মানুষের জগতের সকল ভাবের সম্মিলনে তার সাহিত্যচর্চায় উঠে আসবে সত্য আর সুন্দর। এই চর্চায় এক জিনিসের উপস্থিতি মানে আরেক জিনিসের অনুপস্থিতি নয়। এখানে সব কিছুই বর্তমান।
“এই যে ভাই, বাতিঘরের স্টলটি কোনদিকে বলতে পারবেন?”
টিফু কল্পনার দুনিয়া থেকে বাস্তবে ফিরে আসে।
“না, বলতে পারব না, আমি ভ্রাম্যমান তথ্যকেন্দ্র নই।”
“তাহলে আপনি কি?” বলেই লোকটি হনহন করে হেটে চলে যায়৷ এরকম প্রশ্নের জন্য টিফু মোটেও প্রস্তুত ছিল না৷ তার ঐভাবে উত্তর দেয়াটা ঠিক হয়নি৷ টিফুর কানে বাজতে থাকে, “তাহলে আপনি কি?”