আমার বড় ভাই কলেজে বাণিজ্য বিভাগ থেকে প্রথম স্থান অধিকার না করলে সেই ক্লাস এইটেই সমরেশ মজুমদারের লেখা পড়ার সুযোগ হাতে আসত না। পায়ে তীর গেঁথে রক্তাক্ত প্রচ্ছদ দেখে সেদিন স্কুল থেকে ফিরেই ভাবলাম আজকে আর মাঠে খেলতে যাব না, বইটা পড়া শুরু করব। বইয়ের নামটার মধ্যেও কেমন যেন একটা আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম। কালপুরুষ। আমিও অনেক বই পুরস্কার হিসেবে পেয়েছি কিন্তু সেগুলো ঠিক গল্পের বই না। ফেরেশতাদের আর জ্বীন জাতির ইতিহাস ধরনের বই। তবে শেক্সপিয়ার রচনাসমগ্র পেয়েছিলাম ক্লাস সেভেনে। নাটকগুলো উপন্যাসের মতো করে বাংলায় অনুবাদ করা। সেই অনুবাদ গ্রন্থ অনেক আগেই পড়া শেষ। আউট বই পড়ার একমাত্র উপায় ছিল এই পুরস্কার পাওয়া বইগুলো। আশেপাশে কোথাও কোন লাইব্রেরী নাই, থাকলেও বিক্রি করে শুধু পাঠ্যবই। আর গল্পের বই থাকলেও যে অনেক কিনতে পারতাম তা নয়। আমাদের টেক্সট বই-ই কিনতে হয় টাকার হিসাব নিকাশ করে। স্কুল আর কলেজ পড়ুয়া দুই ভাই এক বোন। পাঠ্যবইয়ের গল্প উপন্যাস কেউ আনন্দ নিয়ে পড়ে না, নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য পড়ে।
কালপুরুষ উপন্যাসটি হাতে পেয়েই বসে পড়লাম জানলার সামনে। বিকেলের আলোয় বুঝে না বুঝে কিংবা কম বুঝে পড়তে লাগলাম। আমাদের যুগে গ্রামের একজন ক্লাস এইটের ছাত্রের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা থাকবে এটা কেউ আশা করে না। ইতিহাসে অনেক সময় গেছে যখন ক্লাস ফাইভের ছাত্ররাও রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি দিয়ে আলোড়িত হত। আমাদের সময় শুধু লেখাপড়া আর লেখাপড়া। ছাত্রনং অধ্যয়ন তপ! অধ্যয়নই ছাত্রদের তপস্যা। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত তো অবশ্যই। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা সবাই জ্ঞাত। আমার মতো মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের স্বপ্ন থাকে একটাই- লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হওয়া, বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করা, তাদের দুঃখ কষ্ট লাঘব করা। আর এই লেখাপড়া মানেই টেক্সট বই পড়া। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই হল আউট বই, এসব পড়ার মধ্যে পড়ে না। লুকিয়ে চুকিয়ে বাবা মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব বই পড়ার অভিজ্ঞতার গল্প-ভান্ডার বিশাল। তবে বিকেলে মাঠে খেলতে না গিয়ে এসব বই আমি পড়তেই পারি, এই ভেবেই শুরু করেছিলাম কালপুরুষ পড়া। বিকেলের আলো গোধুলীর অন্ধকারে পরিণত হলে আমার আম্মা একবার শুধু বলে গেল, চোখ নষ্ট করবি তো!
বিভিন্ন ধরনের আউট বই এভাবে কম আলোতে পড়তে পড়তে আসলেই আমার চোখ নষ্ট হয়ে গেল। নষ্ট হয়ে গেল মানে অন্ধ হয়ে গেল তা নয়। চোখের পাওয়ার কমে যায়, মাইয়োপিক হয়ে গেলাম। দূরের জিনিস ঝাঁপসা দেখি। ব্যাপারটা ধরা পড়ে ঢাকায় কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে। ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে বসলে ত্রিকোণমিতির হেদায়েত স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে সাইন কস থিটা কি লিখেন তা ঠিকঠাক মতো দেখি না। ফার্মগেটের ইস্পাহানী চক্ষু হাসপাতালে চোখ পরীক্ষা করে চশমা নেই। মাইনাস ১ এবং মাইনাস ১.২৫। চশমা নেয়ার পর গল্পের বই পড়ার নেশা আরও বেড়ে গেল। চশমা পরা ছেলে, বেশি বেশি বই না পড়লে কি মানায়! তাছাড়া এখন আর ভয় কিসের? চোখের পাওয়ার আর কমতে পারবে না। চশমা তো নাকের ডগায় আছেই। ডাক্তার বলে দিয়েছিল, ঘুম আর গোসল বাদে সব সময় চশমা পরে থাকতে। তাহলে পাওয়ার যা আছে তা ঠিক থাকবে। সেই ২০০৬ সালের কথা। আজ আঠেরো বছর পরেও আমার চোখের পাওয়ার মাইনাস ১ আর মাইনাস ১.২৫। কলেজ হোস্টেলে সারা রাত জেগে জেগে গল্প উপন্যাস পড়াও আমার চোখের আর কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। ক্ষতি করেছিল এইচএসসি এর ফলাফল কে।
তবে কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে, এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেই আশেপাশের দুই উপজেলা শহরের টেক্সট বই বিক্রি করা লাইব্রেরীগুলোতে সুযোগ পেলেই বাসে চেপে চলে যেতাম। পাবলিক লাইব্রেরী বলতে একটা ব্যাপার থাকলেও এসব উপজেলা শহরের সেসব লাইব্রেরীর সন্ধান তখন আমার জানা ছিল না। কারও মুখে কখনও শুনিও নাই। তাই বইয়ের দোকানে গিয়ে গল্পের বইয়ের খোঁজ করি। কালপুরুষ লেখকের অন্য কোন বই আছে কিনা? নাই। আমার বড় ভাইয়ের কলেজের শিক্ষকেরা নিশ্চয়ই জেলা শহর থেকে বই কিনে পুরস্কার দিয়েছে। জেলা শহরে আমি যেতে পারব না। নদীর উপর ব্রিজ নাই, রাস্তাঘাট ভাঙ্গাচোরা। যেতে হয় ভেঙ্গে ভেঙ্গে। টাকাও লাগে বেশ। তাছাড়া একা যাওয়ার সাহসও হয় না। আবার শুধু বই কিনতে জেলা সদরে যাওয়া এক ধরনের বিলাসিতা। বিশেষ কোন কাজে গেলে নাহয় ফেরার পথে এসব বিলাসিতা করা যায়। একমাত্র উপায় ডাইরেক্ট বাস যায় এরকম উপজেলা শহরে যাওয়া।
উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, মৌষলকাল এসব যে সিক্যুয়েল তা বড় হয়ে জেনেছি। একথা তখন না জেনেই বইয়ের দোকানে কালপুরুষ লেখকের কোন বই না পেয়ে অন্য লেখকদের যেসব বই পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্য থেকে দামে কম পড়বে এরকম কয়েকটা বই কিনি। সমসাময়িক লেখকদের কোন বই পাওয়া যায় না। হুমায়ুন আহমেদের নামও শুনি নাই। বিটিভিতে তার রচিত ও পরিচালিত নাটক দেখেছি । সেটাও রচয়িতা আর পরিচালকের নাম না জেনেই। ওই বয়সে মানুষ মনে রাখে নাটকের কুশীলবদের, রচয়িতাদের নয়। তাই কিনলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র আর বঙ্কিম।
বঙ্কিমের কঠিন ভাষাও আমাকে গোধূলির অন্ধকারে বই পড়া থেকে নিবৃত করতে পারে নি। আনন্দমঠ আর চন্দ্রশেখর পড়তে পড়তে মাগরেবের আজান পড়ে যেত। আর অজান্তেই আমার চোখের পাওয়ারও কমে যেতে থাকত। “আমার বাংলা বই” বা সাহিত্যপাঠের লেখক পরিচিতি মুখস্থ করতে হয় নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন পরীক্ষায় আসে বলে। বিশেষ করে লেখকের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য কর্মের নাম মনে রাখতে পারলে কমন পড়বেই। উপজেলা শহরে বই কিনতে গিয়ে লেখক পরিচিতির সেসব মুখস্থ জ্ঞান বেশ কাজে লেগে যেত। পরবর্তিতেও অনেক কাজে লেগেছে। অমুক লেখকের অমুক বই কি আছে? এরকম প্রশ্নের উত্তর বইয়ের দোকানীর মুখে মুখস্থ বুলির মতো শুনাতো। “না, নাই” ।
আমাদের হাই স্কুলটির বয়স একশো বছরেরও বেশি। ১৯১৬ সালে স্থানীয় জমিদার স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করে। স্কুল কলেজে পড়ার সময় স্কুল কলেজের ত্রুটি বিচ্যুতি চোখে পড়ে না, পড়ার কথাও না। ওই সময়গুলো কাটে কৈশোরের আচ্ছন্নাবৃত সরলতায় আর মুগ্ধতায়, নিজের একটা জগতে। এই শতবর্ষী স্কুলে কোনো পাঠাগার ছিল না। স্কুলে যে পাঠাগার থাকে সেটাই আমার জানা হতো না যদি না আমি আমার ফুপাতো ভাই বুলবুলের স্কুলে বেড়াতে না যেতাম। আম কাঁঠালের সময়ে ফুপুর বাড়িতে থাকতে যেতাম। সপ্তাহখানেক থাকতাম। এর মধ্যে একদিন বুলবুল আমাকে সাথে করে ওর স্কুলে নিয়ে যায়। ধানখেতের আইল ধরে ঘন্টাখানেকের মতো হেঁটে বুলবুলের স্কুলে যেতে হয়। আমি আমার স্কুলে যাই পাঁচ মিনিটে হেঁটে। জমিদার বাড়ির সামনের বিশাল মাঠের উপর দিয়ে। আমার স্কুল বুলবুলের স্কুলের চেয়ে ঢের ভালো। মনে মনে গর্ব করলাম।
বুলবুল আমাকে ওদের পাঠাগারে বসিয়ে রেখে ক্লাসে চলে গেল। আমি দশ বারোটা আলমারি ভর্তি বই দেখে হা হয়ে গেলাম। আলমারির কাঁচের দরজা দিয়ে বইগুলো আমার হা করা মুখের দিকে ব্যঙ্গ করে চেয়ে আছে। তোমাদের স্কুলে কোন পাঠাগার নাই। তবে পাঠাগার না থাকলেও বই যে ছিল না তা নয়। টিচাররুমে দেয়ালঘেষা শালকাঠের আলমারি ভর্তি বই। সবগুলো বই চামড়া কিংবা রেক্সিনে বাঁধাই করা। তাই কাঁচের মধ্য দিয়ে বইয়ের নাম পড়ার উপায় নাই। আলমারি থেকে বের করে পড়তে হবে। পাঁচ বছরের স্কুল জীবনে আমি এসব বই আর আলমারিকে শিক্ষকদের একচ্ছত্র সম্পদ বলে ভেবেছি। সাহস করে কখনও আলমারির কাছে গিয়ে উঁকি পর্যন্ত দেইনি। আমার শিক্ষদেরও কখনও এসব বই নাড়াচাড়া করতে তো দূরের কথা আলমারিই কখনও খুলতে দেখিনি। অনেকবার ভেবেছি পাঠাগার চেয়ে হেড স্যারকে একটা আবেদনপত্র দেব। কিন্তু দেয়া হয় নি। যা একটু দেয়ার ইচ্ছা ছিল তাও একদিন উবে গেল। পাঠাদের আগার =পাঠাগার। আমার এক স্কুলফ্রেন্ড ওমরের বাংলা ব্যকরণের কর্মধারয় সমাসের এমন তাৎক্ষনিক জ্ঞানের মোজেজা দেখে ওর সম্পর্কে আমার ধারণাই বদলে গেল। ওকে আমি গাঁধা টাইপের মনে করতাম। কিন্তু ও মোটেও তা নয়। বাংলা ব্যকরণ জ্ঞান যার এমন প্রখর তাকে এতদিন গাঁধা ভেবেছি সেটা ভেবে স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে মনটা বেশ খারাপ লাগল। বিকেলে মাঠে খেলতে এলে ওমরকে আনোয়ারের ভ্রাম্যমান দোকানের ঝালমুড়ি খাওয়াব বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলাম।
আমার ফুপাতো ভাইয়ের স্কুলের পাঠাগারে সমরেশ মজুমদারের বই খুঁজেছিলাম। পাইনি। তাই লাইব্রেরিয়ানকে বলে অন্য একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। বইয়ের নাম আজ আর মনে নাই। মনে আছে শুধু পাঠাগারটিকে। জানলা দিয়ে তাকালেই দেখা যায় দূরের বড় রাস্তা অবধি প্রসারিত ধানক্ষেত। বাতাস এসে বারবার বইয়ের পাতা উলটে দিচ্ছে।
গত ডিসেম্বরে বান্দরবান গিয়েছিলাম। স্লিপার বাসে বেশ আরামেই ঘুমিয়ে ধনেশ পাখির মোড়ে নেমে শরীর বেশ চাঙ্গাই লাগল। দীর্ঘ ভ্রমনের ক্লান্তি নাই। চা খেলে যা একটু ম্যাজম্যাজ ভাব আছে সেটাও কেটে যাবে। পাশেই একটা চায়ের দোকানে বসলাম। আয়েশ করে চা খেতে খেতে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মিলনছড়ির হিল সাইড রিসোর্ট থেকে গাড়ি আসার কথা। চায়ে চুমুক দিতে দিতে গুগলে বান্দরবান শহরের বইয়ের দোকানগুলোর খোঁজ করতে থাকি। কোথাও ঘুরতে গেলে সেখান থেকে বই কেনা আমার এক ধরণের শখ। শুধু বই নয়, স্থানীয় পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন এসবও পেলে সাথে করে নিয়ে আসি। গুগলে বইয়ের দোকানের ঠিকানা পেলাম না। চায়ের দোকানদারকেও জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করল না। কয়েকদিন তো আছি, এক বিকেলে শহরে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ে যাবে।
রিসোর্টে পৌঁছে রিসেপশনের ব্যালকনিতে বসে নাস্তা সেরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আশপাশটা একটু চোখ মেলে তাকাতেই ডান পাশে ইনডোর গেমস রুম দেখে ওইদিকে হেঁটে যাই। রুমের এক পাশে তিনটা আলমারিতে বেশ অনেক বই রাখা। বইগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। অনেকদিন ডাস্টিং করাও হয় না। বান্দরবানের প্রথম দিককার দুই একটা রিসোর্টগুলোর একটি হল হিলসাইড রিসোর্ট। এমনকি এই এলাকার নাম মিলনছড়ি হয়ে গেছে হিলসাইড রিসোর্টের মালিকের নামে। কিন্তু সেই সোনালী অতীত এখন ধুলায় ঢেকে আছে। গেস্ট তেমন একটা আসে না। যারা আসে তারাও শুধু এখানকার রেস্তোঁরাতে খাওয়ার জন্য আসে। রুম ভাড়া করে থাকার জন্য না। এদের খাবারের সুনাম Sairu Hill Resort-ও কেড়ে নিতে পারেনি। কয়েকটা জিনিস ছাড়া জায়গাটি আমাদের বেশ ভালই লাগল। পাহাড়ের মাথার উপর জায়গায় জায়গায় আটটার মতো কটেজ। সেই হিসেবে হিলটপ রিসোর্ট ও নাম হতে পারতো। কোনটাতে যেতে মাটি কেটে বানানো ধাপ বেয়ে উপরে উঠতে হয় আবার কোনটাতে নিচে নামতে হয়। কটেজগুলোর আলাদা আলাদা নাম আছে। নামগুলো পাখির নামে দেয়া। আমরা যেটাতে ছিলাম সেটার নাম ময়না। পাশেই ছিল ধনেশ। কিন্তু আমার ভালো লাগা বাড়িয়ে দিল পুরাতন ধাঁচের ওই রিডিং স্পেস টি। বইগুলো যে রিসোর্টের মালিকের ব্যক্তিগত সংগ্রহের অংশ সেটা বুঝতে বাকি রইল না। অনেক বইয়ের ভেতরে নানা রকমের লেখা দেখে তাই মনে হল। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের আনন্দ পাবলিশার্সের অনেকগুলো অরিজিনাল বই দেখলাম। মালিকের স্ত্রী নাকি কোলকাতার মানুষ। কিছু স্থানীয় লিটল ম্যাগাজিনও চোখে পড়ল। কিন্তু সমরেশ মজুমদারের কোন বই দেখলাম না।
রিসেপশনের কাউন্টারের পাশে পুরো রিসোর্টের হাতে একা একটা ম্যাপ আছে। ওই ম্যাপ ভালো করে দেখার জন্য এগিয়ে যেতেই কাউন্টারের উপর একটা বই দেখে সেদিকে গেলাম। সমরেশ মজুমদারের “পরানের পদ্মবনে”। এই নামে লেখকের কোনো বই আছে সেটা আমার জানা ছিল না। জানা থাকার কথাও না। কয়েকশো বই লিখেছেন তিনি। কয়টাই বা পড়েছি বা নাম জানি। নাম দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম উপন্যাস। ফ্ল্যাপের লেখা আর ভেতরে এক নজর পড়ে বুঝলাম স্মৃতিকথা। সাপ্তাহিকভাবে এক বছরের মতো প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়, সম্ভবত দেশ পত্রিকায়। পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়। যে কয়দিন বান্দরবানে ছিলাম সকালে নাস্তার পর চা খেতে খেতে আর রাতে খাওয়ার পর বইটা আমার সার্বক্ষনিক সঙ্গী হয়ে রইল। সাথে করে বিভূতিভূষনের “আরণ্যক” নিয়ে গিয়েছিলাম বাসা থেকে। ভাবলাম বনে পাহাড়ে বইটা আবার পড়লে অন্য রকম পাঠের অভিজ্ঞতা হবে। কিন্তু সমরেশ হারিয়ে দিল বিভূতিকে। বইটা সমরেশের নানা সময়ের স্মৃতির রোমন্থন। আমার বরাবরই স্মৃতিকথা পড়তে ভালো লাগে। তাই কিনা বইটা বেশ ভালই লাগল। দূরে পাহাড়ের সারি সামনে রেখে, গাছে গাছে কাঠবিড়ালীদের দৌড়াদৌড়ি দেখে, নানা রকমের পাখিদের কিচিরমিচির শুনে শীতের সকালে চা খেতে খেতে যেকোন বই-ই মনে হয় ভালো লাগার কথা।
বইটা পড়া শেষ করতে পারলাম না। ঢাকায় ফেরার রাত চলে আসল। ভাবলাম ঢাকায় গিয়ে বইটা কিনে ফেলব। রকমারিতে সার্চ করে দেখলাম। কিন্তু আনন্দ পাবলিশার্সের এডিশন পাওয়া যাচ্ছে না। আমার এই এডিশনটিই লাগবে। এই প্রচ্ছদের বইটাই। কাভারের উপর ম্যাপল পাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, টুকরো টুকরো স্মৃতির মতো। প্রচ্ছদ দেখলেই যেন বান্দরবানের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে অন্য প্রচ্ছদের একটা সংস্করণ। বাংলাদেশের নবযুগ প্রকাশনীর বই। ঢাকায় এসে বাতিঘর, পাঠক সমাবেশ, বেঙ্গল বই, আজিজের সব বইয়ের দোকান ঘুরেও আনন্দ পাবলিশার্সের এডিশনটি পেলাম না। বোলপুরে শান্তি নিকেতনে আমার এক বন্ধু থাকে। কিছুদিন পরেই নাকি ঢাকায় আসবে। ভাবলাম ওকে আনতে বলে দেব। কিন্তু সেটাও নানা কারনে বলা হল না। শেষমেশ নবযুগের সংস্করণটিই রকমারিতে অর্ডার করলাম। বইটা হাতে পেয়ে অত উচ্ছ্বসিত হতে পারলাম না। বান্দরবানের বইটার মতো মায়াভরা মনে হল না। বাঁশি তো আর আগের মতো বাজে না। তবুও না পড়া অংশগুলো পড়ে শেষ করলাম।
দেশ পত্রিকা বলা যায় নিয়মিতই কিনি। বাতিঘরেই বোধহয় সবার আগে পাওয়া যায়। দুই তারিখের সংখ্যা ছয় কিংবা সাত তারিখের মধ্যেই চলে আসে। সতেরো তারিখেরটার বেলায়ও তাই। দেশ পত্রিকার গত বছরের পূজা সংখ্যা কেনার সময় টের পাইনি এই সংখ্যায় সমরেশ মজুমদারের লেখা আছে। আমি এমনিতে সূচিপত্র ঘাটাঘাটি করে পত্রিকা ম্যাগাজিন কিনি। সেবার তা করা হয় নাই। বাসায় এসে সূচিপত্রে চোখ বুলাতেই নজরে আসে সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসটি। উনকি। কিছুদিন পরেই বই আকারে বের হয়।
এসব নানা সময়ে সমরেশ পাঠের স্মৃতির পদ্মবন থেকে উঠে আসা কয়েকটা পদ্ম মাত্র। রয়ে গেল পুরো পদ্মবন।
কিছুদিন আগে ফেসবুকে সমরেশ মজুমদারের “বুঝেসুজে বেঁচে থাকা” গল্পের কয়েকটা লাইন দেখে গল্পটা পড়ার খুব ইচ্ছা জাগে। অনেক উপন্যাস পড়লেও সমরেশের তেমন কোনো গল্প পড়ি নাই আমি। লাইনগুলো গল্পটি পড়ার জন্য বেশ টানল। কিন্তু এই রাতের বেলায় বই পাব কোথায়! ইন্টারনেটে সার্চ করতেই বাংলা সাহিত্যের উপর একটা সাইটে গল্পটা পেয়ে গেলাম আর পড়ে ফেললাম। সমরেশ আমাকে “কালপুরুষ” দিয়ে আমার অজান্তেই সেই কবেই বুঝেসুজে বেঁচে থেকে জীবনের সুধারস পান করা শিখিয়েছিলেন।
“সারাদিন সঙ্গোপনে সুধারস ঢালবে মনে
পরানের পদ্মবনে বিরহের বীণাপাণি।“