প্রথম পাতা » গল্প » একটি অ্যাভোকাডোর আত্মকাহিনী

একটি অ্যাভোকাডোর আত্মকাহিনী

avocado

আমার নাম অ্যাভোকাডো। বৈজ্ঞানিক নাম Persea Americana. আমি মূলত নিজেকে মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার পরিচয় দিয়ে চলি। আপনার যেমন একটা সংক্ষিপ্ত নাম আছে, তেমনি আমারও একটা আছে :- অ্যাভো। গাছ থেকে তুলে এনে বিক্রয় করার জন্য আমাকে বাজারে তোলা হয়। আমি কতটুকু সুুন্দরী তা বলতে পারবো না। ওজনে ৩০০ থেকে ৭০০ গ্রামের মধ্যে আছি। আমি যেমন পুষ্টিতে ভরপুর, তেমনি ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ। আমাকে দেখলেই ছোট বড়, নারী পুরুষ, শিশু কিশোর সবাই লালায়িত হয়। 

আমি অ্যাভো। আমার ভিতরের অংশ মাখনের মতো মসৃণ। আমাকে আদর করে না, এমন মানুষের জুড়ি মেলা মুশকিল। দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে সবার। আমি রক্ত চাপ কমাতে সাহায্য করি। তবে আমার উপর মানুষের দৃষ্টি পড়া মাত্র মানষিক রক্ত চাপ বেড়ে যায় সবারই। দেখা মাত্র আমার শরীরে একটা টিপুনি না কাঁটলে মনে হয় দিনটাই বৃথা তার। টিপ দেওয়ার জন্য ওদরহাতের মধ্যে  যদি কেউ টিপ দেওয়ার সুযোগ না পায়, তবে তার হাতের মধ্যে উসখুস উসখুস করে। 

আমার উপরের খোসা কুমিরের গায়ের মতো। খোসা অমসৃণ হওয়াতে আমাকে অনেকেই কুমির নাশপতি বলে থাকে। 

বাজার থেকে আমাকে নিয়ে এলো এক দোকান মালিক। তার উদ্দেশ্য, কারো কাছে বিক্রয় করে কিছু মুনাফা ঘরে নেওয়া। আমার মধ্যে উপস্থিতি আছে ফলিক এসিড, যেটা খনিজ পদার্থের আওতায়। গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টি সরবরাহ করতে দারুণ ভূমিকা পালন করে থাকি। এই কারণে, ক্রেতাদের অতি সহজে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে খুবই যত্ন সহকারে বিক্রেতার হাত নিকটবর্তী স্থানে রেখে দেওয়া হয়। 

বিক্রেতার হাতের নিকটস্থ স্থানে রাখারও কয়েকটি কারণ আছে। একটু অসাবধানতার নিমিত্তে আমি চুরি হয়ে যাই। আমার ভিতরে যে ম্যাগনেসিয়াম আছে তাতে ঘুম আনয়নে সহায়তা প্রদান করে। কাজে কাজেই, কেউ চুরি করে নিয়ে গেলেও চিৎকার করতে পারি না। 

তবে চুরি করতে পারুক বা নাই পারুক, আমাকে আদর করে টিপ দেয় না, এমন লোক কম আছে। আমাকে কাঁচা, পাকা সবজি হিসেবে ব্যবহার যেমন করতে পারে, তেমনি আবার ভর্তা, সালাদ, শরবতসহ বিভিন্ন ভাবে প্রয়োগ করতে পারে। এমন উপকারিতার কথা জানা আছে ইবি জঙ্গার। ইবি জঙ্গা দোকানে এসেছিল টাকা ভাংতি করতে। টাকা ভাংতি করতে ক্যাশ বাক্সটার দিকে যাওয়া মাত্র, আমার নরম শরীরে চুরি করে দিল একটা টিপ। 

আমি বুঝতে পারলাম, বিক্রেতার মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে মানসিক অবস্হার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল, আমাকে এই অহেতুক টিপ দেওয়ার কারণে। আসলে এমন মেজাজে মানসিক ধাত খারাপ হওয়ারই কথা। আমি অ্যাভো, আমারও তো রাগ আছে। হোক না হোক একেকজন এসে টিপ দিয়ে দেয়। কিন্তু তাদের কপালের জোর যে, আমার হাত নেই। হাত থাকলে কত মানুষের যে দাঁত পড়ে যেতো, তার কোনো হদিস নেই। পা থাকলে ফুটবলের মতো কিক মেরে প্যান্ট ফাটিয়ে দিতাম। 

আমার মধ্যে আছে ফাইবার, যা হজম শক্তি বৃদ্ধি করি। ওজন নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করি। লিভারের অলসতা দূর করে উহার কার্যক্রমের ব্যাপারে শক্তিশালী ভূমিকা রাখি। ফাইবার কিন্তু রক্তে সুগারের মাত্রা কমাতে খুবই ধুরন্ধর। 

মহিলা মাস্টার, তাঁর মধ্যেও আমাকে টিপ দেওয়ার মতো কুদরতি ক্ষমতা আছে, সুকৌশলে বিক্রেতার চোখ ফাঁকি দিতে পটু কম না। আমার বিক্রেতার কাছে এসেছেন সিগারেট ধরানোর জন্য ম্যাচ নিতে। ম্যাচটা দেওয়ার জন্য বিক্রেতা মাথা নিচু করা মাত্র মাস্টার ঝটপট করে আমার শরীরের দুই প্রান্তে দুইটা চাপ মেরে দিলেন। চাপ খেয়ে তো আমি বাঁকা হয়ে গেলাম। ঘন্টা খানেক পরেই চাপ দেওয়া জায়গায় পচন শুরু হয়ে গেল। আমি আমার নিজের ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও অন্যের ক্যান্সার ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে বেশ সহায়ক। 

শরীরে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্যালোরী জমা বা ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে ও ধমনী ফলকের ধীর বিকাশ ঘটাতে আমি এ্যাভো অত্যন্ত পারদর্শী। অস্বাভাবিক হার্ট স্পন্দন, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের সম্ভাবনা হ্রাস করতে আমার চেয়ে উন্নত গুণাবলী খাবার আছে কিনা, তা আমার জানা নেই। তবে আমার নিকট যদি কোনো কাস্টমার এসে দাঁড়ায়, তবে ভয়ে আমার নিজের স্পন্দন বেড়ে যায়। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। এই বুঝি দুই আংগুল দিয়ে চাপ দিল। উল্টা পাল্টা চাপ খাওয়ার আতংকে স্ট্রোক করি করি অবস্থা। 

প্যান কেক ও স্যান্ডউইচের সাথে আমি মানানসই হই দারুণ ভাবে। লেবুর রস, দুধ, ক্রিম দিয়ে আইসক্রিম বানালে স্বাদে হই অসম্ভব রকমের মজাদার। আফ্রিকার মানুষ ব্রেডের স্লাইসের সঙ্গে আমাকে লাগিয়ে খায়নি এমন লোক একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, সেটা নিশ্চিত বলা যায়। আবার এই খাবারটি প্রস্তুত করতেও দ্রুত ও সহজ হয়। 

এক মহিলা দোকান থেকে ৪/৫ টা আইটেমের বাজার নিয়ে কাউন্টারে রাখার সাথে সাথে ত্বরন্বিতভাবে ঝটপট করে দ্রুতার সঙ্গে আমাকে টিপ মেরে দিল। আমাকে কেনার জন্য বিন্দু পরিমাণ আকাঙ্ক্ষার তৃষ্ণা ছিল না ঐ মহিলার মনে। জাস্ট দুটো টিপ দিয়ে তার খায়েশ পূর্ণ করলো। আমি মরি মা বাঁচি তা উনার দেখার প্রয়োজন নেই। অথবা আমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে পঙ্গু করার জন্য এই মহিলার মধ্যে কোনো দায়বদ্ধতা আছে বলে সে মনে করে নাই। আমাকে মারার চেয়ে তার খেয়ালী ইচ্ছে পূরণ করে মনের মধ্যে পরমানন্দের তৃপ্তি সঞ্চয় করলো। 

কিবরিয়া একদিন আমাকে অতিশয় যত্ন সহকারে নিয়ে গেল তার শয়ন কক্ষে। উদ্দেশ্য ছিল আমাকে দুধ, চিনি, বরফ আর পুদিনাপাতার সাথে গুলিয়ে শরবত বানিয়ে খাবে। 

রুমে এনে সুতা দিয়ে বেঁধে ঘরের একটা আড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে দিল। উদ্দেশ্য, সকালে শরবত বানাবে। আমি তো ফ্যানের বাতাসে দোল নিচ্ছি। এমন মূহুর্তে আমার মাথায় একটা কু-বুদ্ধি এসে গেল। রাত বাজে তিনটা। কু-বুদ্ধি অনুযায়ী সুতা থেকে পড়ে গেলাম একটা প্লেটের উপর। স্টিলের এই প্লেট দিয়ে ঢাকা ছিল শুঁটকি মাছের তরকারি। শুঁটকির ঘ্রাণ পেয়ে দৌড়ে এলো একটা বিড়াল। রাত তিনটায় প্লেটে সাথে আরেক প্লেট বাড়ি খেয়ে ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল। ঝলাকৃতি তরকারি টেবিলের উপর লটকায়ে দিয়ে আমি চলে গেলাম খাটের নিচেই। ঘুমন্ত কিবরিয়ার আকস্মিক ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভয়ে সে চোর চোর বলে চিক্কুর দিল। 

আমি তো ভয়ে চুপচাপ খাটের নিচে। এত রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় কিবরিয়ার মেজাজ এখন মেলেটারি হয়ে আছে। আমাকে পেলে নিশ্চয় সে আস্ত রাখবে না আমায়। কিবরিয়া রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিল। অতঃপর সে প্রকৃত ঘটনা বুঝতে পারে। 

কিবরিয়া আমাকে খুঁজতে লাগে। অবশেষে পেয়েও গেল। মুঠোবন্দি করে আমাকে তুলে নিল। আমি ভয়ে তো দিশেহারা। এত রাতে ঘুম ভেঙ্গেছি তার। মেজাজ গম্ভীর ও খিটখিটে ভাব হয়ে আছে। ও হয়তো আমাকে এক আছার দিয়ে বিচিটাই বের করে দিবে। 

কিন্তু না, আমি তো অ্যাভো। হাতছাড়া করতে কে চায়? আমি মানুষের দেহকে সোডিয়াম, সুগার কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখি। হার্টকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কত-না তেলেসমাতি দেখিয়ে থাকি। এ রোগ নিয়ন্ত্রণে আমি ভিষণ কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারি। আমি এত গুণাবলি সম্মৃদ্ধ হওয়ায় আছার দেওয়া তো দূরের কথা, বরং আমাকে একটা কাঁচের পাত্রে যত্ন সহকারে রেখে দিল।

মানব দেহের জন্য আমার মধ্যে উপকারী ফ্যাট যথেষ্ট রয়েছে। এছাড়া ভিটামিন-ই প্রচুর আছে। সুতরাং, যেমন পাওয়া  যাচ্ছে লুটেইন, তেমন পাওয়া যাবে ক্যারোটিন। যেথায় থাকে ভিটামিন- ই, সেথায় উপস্থিত জেক্সানথিন। আর এরা সবাই একত্রিত হয়ে চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি ও ছানি পড়া রোধ করা সহ চোখের অন্যান্য স্বাস্থ্য ঠিকঠাক রাখতে পারঙ্গমতাবোধ করি। ভিটামিন- ই এর পাশাপাশি ভিটামিন-বি ও ভিটামিন-সি রেখেছি। ফলে ত্বক ও চুলের উপকার করতে কখনোই ভুলি না। ভিটামিন- সি  থাকতে রোগ প্রতিরোধ না করে চুপচাপ রইতে পারি না। আর ভিটামিন ই বাতের ব্যথা উপশম করার জন্য সর্বদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করি। 

সেদিন একজন দোকানে এসেছে দেড় টাকার Sasko বিস্কুট কিনতে। তার কাছে আছেই মাত্র দুই টাকা। বিক্রেতা কৌটা থেকে বিস্কুট দেওয়া জন্য প্রস্তুত। এমন সময় এই ক্রেতা আমাকে দিয়ে দিল দুই আঙুল দিয়ে চাপ বা ঠাসা। এতে আমার শরীরে একটা জায়গার চামড়া ছিঁড়ে গেল। আমার ভুঁড়ি বের দিল। সেটা দেখে ফেলেছে আমার মালিক। বিস্কুট ক্রেতাকে চাপ দেওয়ার কথা জিজ্ঞেস করা মাত্র, সে অস্বীকার করে। আমার চামড়া ছিঁড়ে ভুঁড়ি বের হয়ে যাওয়ার কারণে বসের মেজাজ হলো দারুণ খ্যাপা। অস্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে তাকে কিছু উত্তম- মাধ্যম দিয়ে দোকান থেকে বেরে করে দিল। 

আপনার গুণ আপনি না গাইলে কে গায়? আবার এওতো আছে :- লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়। যাই হোক, নিজের গুণ আরেকটু গাইতে চাই। আমার মধ্যে পটাশিয়াম রেখেছি। আর এই পটাশিয়াম দাঁতের অবক্ষয় রোধ করে, মাড়ি ফোলা দূর করে। মুখে বাজে গন্ধ থাকলে সেটাও দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে থাকে এই পটাশিয়াম। আমি নিজের গুণ নিজেই শুধু গাইতে থাকি না। আমার মধ্যে গুণ আছে বলেই তো, দেখা মাত্রই আদর করে টিপ দেয়। এই টিপ দেওয়া সহ্য করতে পারে না শুধুমাত্র বিক্রেতা। অনেকেই আছেন আমার গুণের কারণে, আমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করেন না। শুধু আমার মালিকের নিকট জিজ্ঞেস করেন, নরম কি না? উত্তর যদি হ্যঁ সূচক হয় তবে দাম না শুনেই টাকা দিয়ে কিনে নেন। অন্যরা সবাই তো চাপাচাপির দলে।

মাহফুজার রহমান
দক্ষিণ আফ্রিকা
ফোন নম্বর ০৬২৯৪১৬৮৩৮
rahman.mahfuzar7@gmail.com
Date : 05/03/2024

গল্প থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

মাহফুজার রহমান
মাহফুজার রহমান
কেপটাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *