চঞ্চল চৌধুরী। বাংলাদেশের একজন গুণী অভিনেতা। নাটকের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম বলে তাঁর সাথে প্রথম দেখা মঞ্চে। আরণ্যক নাট্যদলের একজন নাট্যকর্মী তিনি। সম্ভবত ২০০০ সালে প্রথম তাঁকে মঞ্চে দেখি ‘সংক্রান্তি’ নাটকে। ছোট্ট একটা কারেক্টার প্লে করেছিলেন। কিন্তু সেদিনই তাঁকে আলাদা করে চিনে নিয়েছিলাম। এরপর তাঁর দুর্দান্ত অভিনয়ে সাড়াজাগানো মঞ্চনাটক ‘রাঢ়াং’, ‘চে’র সাইকেল’ সহ বেশ কয়েকটি পথনাটকেও তিনি অভিনয় করে মঞ্চসফল অভিনেতা হিসেবে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিলেন।
তাঁর ‘রাঢ়াং’ নাটকের দুর্দান্ত অভিনয় দেখে ‘মনের মানুষ’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য অফার করেন নির্মাতা গৌতম ঘোষ। সিনেমাটিতে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের মনে করে নেন স্থায়ী আসন। এরপর ‘আয়নাবাজি’, এবং হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলী চরিত্রে অভিনয় করেও দর্শকদের প্রশংসা পান তিনি। টিভি নাটকে তাঁর রয়েছে প্রচুর ভক্ত-অনুরাগী। সঞ্চালনা, গায়কী, বিজ্ঞাপনেও তিনি অতুলনীয়। বাংলাদেশের মানুষ তাঁর অভিনয়ে, গানে খুঁজে পায় নির্মল বিনোদনের উৎস। তাঁকে অবিরাম ভালোবাসে এদেশের বিনোদনপ্রিয় মানুষ।
কিন্তু অবিরাম ভালোবাসায় হঠাৎ বিরাম পড়ল সেদিন। মা দিবসে তিনি মায়ের ছবি পোস্ট করায় মায়ের সিঁথির সিঁদুর দেখে বাঙালির আক্কেলের তলে জল পড়ে – এতোদিনে তারা জেনে যায় লোকটি হিন্দু! একজন হিন্দুকে ভালোবাসার দায়ে নিজেদের সাম্প্রদায়িক বিচারদণ্ডে নিজেরাই অপরাধী সাব্যস্ত করেছেন। কেউ কেউ গলায় আঙুল সঞ্চালন করে গিলে ফেলা অনুরাগকে বের করতে পারলে বেঁচে যায় এমন অবস্থা। আফসোসে তারা মরিয়া। কী করলে এই প্রলয়ঙ্কারী পাপ কাটা যাবে সেই চিন্তায় তারা বেসামাল। এর নাম উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। এটি ভয়ঙ্কর।
এর বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন বলে বাংলাদেশ আজো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। আমাদের আরো পাঁচশ বছর বা তার বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে সেক্যুলার এক বাংলার জন্য। কিংবা আমরা প্রতিদিনই পাঁচশ বছর করে পিছিয়ে যাচ্ছি প্রবল সাম্প্রদায়িকতার গর্তের অভিমুখে।
‘আমার আছে জল’ সিনেমায় অভিনয় করেন মীম। দৃশ্যায়নের প্রথম দিন নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ জানলেন মীমের নাম আসলে বিদ্যা সিনহা মীম এবং তিনি হিন্দু। তার পরিবার আরো জানালা যে, এই সিনেমার নায়িকা হওয়ার প্রতিযোগিতায় বিদ্যা সিনহা প্রথম থেকেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত পর্বের আগে আয়োজকদের পরামর্শে তার নামটি কৌশলে পরিবর্তন করা হয়। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কেবল হিন্দু হওয়ার কারণে ‘বিরানব্বই পার্সেন্টওয়ালারা’ তাকে ভোট দেবে না। তাই তার নামটি ‘মীম’ রাখা হয়! ঘটনা শুনে হুমায়ূন আহমেদ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন!
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদকারী হিসেবে গিরিশচন্দ্রের নাম প্রতিষ্ঠিত। যাঁকে সম্মানসূচক ‘ভাই’ উপাধি দেয় উপমহাদেশের মুসলমানেরা। কিন্তু বাংলার মুসলমানেরা খুব দ্রুত ‘ভাই গিরিশচন্দ্রের’ অবদানকে অস্বীকার করার জন্য একজন মাওলানার নাম খু্ঁজে বের করে। এখন কুরআন শরীফের প্রথম বাংলা অনুবাদকের নাম ভাই গিরিশচন্দ্র সেন বললে একটি অংশ বিনয়ের সাথে বলে – ভাই, আপনার তথ্য ঠিক না! কুরআন শরীফ বাংলায় প্রথম অনুবাদ করেন- মাওলানা…..!
নৃ-তাত্ত্বিকেরা বিস্তর গবেষণায় প্রমাণ করেছেন বাঙালি মূলত সংকর জাতি। নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়- এইসব অনার্যরাই এই অঞ্চলের মূল অভিবাসী। এরপর আর্যরা এলে এদের সাথে মিশে যায় বহুবিভক্ত রক্তস্রোত। বাংলার মুসলমানেরা সবাই আরব থেকে আসেনি, মক্কা-মদিনার লোকও এরা না। বাবা আর্য হলে মা অনার্য, মা আর্য হলে বাবা অনার্য। দুইজনের মধ্যে একজন নমশূদ্র হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। এমন মিথস্ক্রিয়ায় গঠিত একটি জাতিগোষ্ঠীর মূল্যবোধ নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
বাংলার মুসলমান এই রমজানে বাঙ্গি-তরমুজ নিয়ে যে কারবার দেখালো তাতে তাদের ধর্মীয় নৈতিকতা কতটা উচ্চমার্গের তা অনুমান করতে মিসির আলী হওয়া লাগে না। লুটপাট, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, ধর্ষণ, খুন, রাহাজানি, মাদকে উন্মাদ এই জাতির ধর্মীয় নসিহত শুনলে না হেসে পারা যায় না। দুর্মুখো এই বরাহ শাবকেরা জানে না শিল্পের কোনো দেশ-কাল-পাত্র হয় না, হিন্দু-মুসলমান হয় না। এরা নজরুলকে জ্বালিয়ে মারছে, রবীন্দ্রনাথকে পুড়িয়ে নিঃশেষ করেছে জীবিতবেলায়। লালন সারাটা জীবন লড়ে গেলেন এদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমরা আজো সেই স্বদেশ পেলাম না- অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। তবে এদের সংখ্যা নেহায়েত কম কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও উদ্বিগ্নতার কারণ আছে যথেষ্ট। এরাই বাংলাকে দাঁড়াতে দেয় না।
চঞ্চল হিন্দু না মুসলমান এই খাউজানি যাদের তারা টিভি দেখে কোন শরিয়তি বিধানে তা-ই তো আমার বুঝে আসে না। এরাতো আধা নটি আধা গেরস্থের মতো। হাফ বয়েল্ড! এরাতো একই পথে চলার কথা যেখানে স-ব হারাম! এসব রিমিক্স মুসলমানতো আরো ক্ষতিকর! ধর্মের আগাছা কোথাকার!!!!
বাংলাদেশে খুব করে একটা কথা প্রচার হয়- মুর্খের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কী হবে? বিশেষ করে রবীন্দ্র প্রসঙ্গে। গত ৭ মে রবীন্দ্রজন্মদিনে বেশ চোখে পড়লো কথাটা। এটা বলে রবীন্দ্রভক্তদের একটু খোঁচা দেওয়া আর কী! রবীন্দ্রনাথ এই কথাটি বলেছেন এমন কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই, প্রমাণও নেই। যাঁর প্রতিটি লেখা, প্রতিটি বাণীর তারিখ ও বার পাওয়া যায় অথচ এতোবড় একটা কথা তিনি বললেন আর এর কোনো প্রমাণই নেই! তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চান নি তো এখানে একাধিকবার এলেন কেন? রবীন্দ্রনাথের দুমুখো নীতিতো পাইনি কোথাও ! এতো এতো লেখা পড়েও! তর্কের খাতিরে ধরলাম তিনি একথা বলেছেন।
আজ ২০২১ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের পথে, যদি একজন অভিনেতাকে ধর্মের মীমাংসার বেড়াজালে পড়তে হয় তবে আমার জিজ্ঞাসা-
এদেশে বিশ্ববিদ্যালয় করে কী লাভ হয়েছে???