প্রথম পাতা » জীবনযাপন » পরিবেশবন্ধু বজ্ররোধক তালগাছ লাগাই

পরিবেশবন্ধু বজ্ররোধক তালগাছ লাগাই

Palm tree

‘তালগাছটি আমার’- কথায় কিংবা তর্কে জিত নেয়ার ক্ষেত্রে এটি খুব প্রচলিত প্রবাদ। এই প্রবাদেও মানে হলো- জোর করে জিত নেয়া কিংবা তালগাছের ন্যায় নিজ যুক্তিতে অনঢ় থাকা। ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/সব গাছ ছাড়িয়ে/উঁকি মারে আকাশে’.. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তালগাছ কবিতায় এমন পংক্তিমালা যেন তালগাছের গুরুত্বকে অনেক বাড়িয়ে দিরেয়ছে। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য রক্ষা ও শোভা বর্ধনে তাল গাছের জুড়ি নেই। তাই আদিকাল থেকে তালগাছ গ্রাম বাংলার শোভা বৃদ্ধিতে অকৃত্রিম ভূমিকা রেখে আসেছে। তালগাছ প্রাকৃতিক শোভার অনন্য উপাদান। সারি সারি তালগাছের সৌন্দর্যের কথা ভাবতেই ভাল লাগে। তালগাছে শিল্পী পাখি বাবুইয়ের বাসা ঝুলে থাকা আর বাতাসে দোল খাওয়া নয়নকারা মনোরম দৃশ্য দেখে মন হারিয়ে যায়।

বাবুই পাখি

তাল গাছের মঞ্জুরির রঙ হলুদ, লম্বা আকৃতির। বসন্তে গাছে ফুল ধরে। মজার ব্যাপারটি হলো- কষ্ট সহিষ্ণু তালগাছ রোপণ করা খুবই সহজ। একটু মাটি খুঁড়ে আঁটি পুঁতে রাখলেই গাছ জন্ম নেয়। তালগাছ দীর্ঘকায় ও ডালপালা না থাকায় ফসলের বা চলাচলের পথে বাঁধা হয়না। পরিচর্যা না করলেও সড়ক, মহাসড়ক, বাঁধ, বেড়িবাঁধ, রেল লাইন, পুকুর পাড়, খালের পাড়, নদীর পাড়, জমির আইল, পতিত জমি এমনকি বসত বাড়ি আশে পাশের সীমানায় তালগাছ রোপণের উপযোগী স্থান। একটি তাল গাছ উচ্চতায় ২০ থেকে ২৫ মিটার হয়ে থাকে এবং ১৪০ থেকে ১৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

তোমরা হয়তো অনেকে জানো না যে, শুধু সৌন্দর্যের দিক দিয়ে নয়, তালগাছ আমাদের অনেক উপকারেও আসে। তালগাছ গ্রামীণ অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে। জেনে রাখো-বাংলাদেশের সব স্থানে কম-বেশি তালগাছ চোখে পড়ে। তবে ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে ভালো তাল উৎপাদন হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বরেন্দ্র অঞ্চলে গরমের তীব্রতা অনেক বেশি থাকায় বেশির ভাগ বাড়ি গরম ও জলবায়ু সহনশীল মাটি দ্বারা তৈরি হয়। আর মাটির বাড়ি তৈরিতে মূল উপাদান মাটির পরেই তালগাছের কাঠের প্রয়োজন হয়। কারণ তালের কাঠে ঘুন পোকা ধরে না এবং শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী তাই মাটির বাড়ির তীর, রূইয়াসহ বিভিন্ন কাজে তালগাছ বহুল ব্যবহৃত। এছাড়াও তালগাছ থেকে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্তর তৈরি হয়- যেমন, তালপাতার হাতপাখা, মাদুর, টুপি, ঘরের ছাউনি, চাটাই, ছাতা, ঝুড়ি, ব্রাশ পাপোশ, ছোট বাস্কেট, মাছ ধরার চাঁই, লাকড়ি প্রভৃতি। তাল কাঠের গোড়ার অংশ দিয়ে ডিঙি নৌকা তৈরি, ঘরের খুঁটি, আড়া, রুয়া, বাটাম, কৃষকের লাঙলের ঈষ তৈরি করা হয়।

Palm tree beauty

আরো জেনে রাখতে পারো তালের স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং বাহারি খাবারের ঐতিহ্যের কথা। তালের রস শরীরের জন্য বেশ উপকারী। তাল পাঁকা ও কাঁচা দু’ভাবেই তাল খাওয়া যায়। কচি তালের নরম শাঁস মুখরোচক পুষ্টিকর, শরীরের পানি শূন্যতা ও ক্লান্তিহীনতা দূর করে, খাবারে রুচি বাড়ায়, লিভার সমস্যা, রক্ত শূন্যতা, বমিভাব আর বিস্বাদ দূরিকরণে উপকারী। তালের রস দিয়ে তৈরি হয় তাল মিশ্রি। ছোটবেলায় দেখতাম তালমিশ্রি ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তালের পুরুষ গাছের ফুল বা জটা হতে রস সংগ্রহ করে তা দিয়ে গুড়, পাটালি, পিঠা, বড়া, লুচি, পায়েস ইত্যাদি তৈরি করা হয়।

জানার বিষয় হলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ও বজ্র নিরোধক হিসেবে তালগাছের অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, গ্রামেগঞ্জে প্রচুর পরিমাণে তালগাছ ও নারিকেল গাছ থাকলে বজ্রপাতে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। শক্ত মজবুত গভীরমূলী বৃক্ষ বলে ঝড়-তুফান, টর্নেডো, বাতাস প্রতিরোধ এবং মাটি ক্ষয় রোধে তাল গাছের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জনমনে প্রচলিত আছে, আগে বজ্রপাত হলে তা তালগাছ বা অন্য কোনও বড় গাছের ওপর পড়তো। আর বজ্রপাতের বিদ্যুৎ রশ্মি গাছ হয়ে তা মাটিতে চলে যেত। এতে জনমানুষের তেমন ক্ষতি হতো না। হঠাৎ করেই বজ্রপাতের পরিমাণ আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাতে মৃত্যুর আশঙ্কা ও ঝুঁকি বেড়ে গেছে। বিশ্বে বজ্রপাতের কারণে মৃত্যু ঘটনায় বাংলাদেশের নাম শীর্ষে উঠে এসেছে। আর একারণেই গুরুত্বহীন তালগাছের গুরুত্বও বেড়ে গেছে। ভাল খবরটি হলো বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে দেশব্যাপী তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যেই সরকারি উদ্যোগে ১০ লাখ তালগাছের চারা রোপণ করা হয়েছে।

সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, বজ্রপাত যেহেতু সাধারণত উঁচু কোন কিছুতে আঘাত করে, বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকানোর জন্য এটাই সবচেয়ে কার্যকর স্থানীয় প্রযুক্তি। যদিও এর পাশাপাশি হাওড় অঞ্চলে টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনাও নিয়েছে সরকার। তাতে মূল পদক্ষেপ হিসেবে দেশের ৬৪ জেলায় তালগাছ লাগানো হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আসাদুল হক বলেন, বজ্রপাত যেহেতু উঁচু জায়গায় আঘাত করে, সে হিসেবে তাল গাছ মৃত্যু কমাতে সহায়ক হবে। কিন্তু বজ্রপাতের আঘাত পাওয়া গাছটি নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি বলেন, হাওড় এলাকায় টাওয়ার নির্মাণ করা হলে বজ্রনিরোধক স্থায়ী ব্যবস্থা হবে।

জানাগেছে, থাইল্যান্ডে তাল গাছ লাগিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। ভিয়েতনামে টাওয়ার দিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমানো হয়েছে। সেই আদলে বাংলাদেশ হাওর এলাকায় তালগাছের পাশাপাশি টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য ও জীব বৈচিত্র রক্ষায় বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কতৃপক্ষ (বিএমডিএ) ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন রাহমশা ও খাড়ির পাশে প্রায় ৭২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গা জুড়ে লাগানো হয়েছে ৩০ লাখের বেশি তালগাছ।

Beauty of Palm Tree

এবার জানব তালগাছপ্রেমীদের কথা। প্রকৃতির শোভা সুরক্ষায় সড়কের পাশে তালগাছ লাগিয়ে সকলের দৃষ্টি কেড়েছেন নড়াইলের লোহাগড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজী বিষয়ের শিক্ষক আল মাহমুদ ইরোজ স্যার। ১৯৮৫ সালে ইরোজ স্যার উপজেলার রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ ভাবে তিন হাজার তালের বীজ রোপন করলে দুই হাজার গাছ বাঁচে। ২০০১ সালে দুই হাজার বিচিতে এক হাজার তিনশত গাছ, ২০১৩ সালে ১৫ হাজার বিচিতে আট হাজার গাছ বড় হতে থাকে। ধারাবাহিকভাবে বাড়ি বাড়ি থেকে তালের বীজ সংগ্রহ করে প্রতি বছরই নড়াইল লোহাগড়া, লহুড়িয়া, কুন্দশী, পাচুড়িয়া, ইতনা-ধলইতলা, কাশীপুর, রাজপুর, কালনা, ও কুন্দশী-মঙ্গলহাটা সড়কসহ উপজেলার বিভিন্ন সড়কের পাশে কম-বেশি করে লাগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জানলে অবাক হবে, পরিবেশপ্রেমী এই মহান শিক্ষক ব্যাংকে স্ত্রীর সঞ্চিত ১ লক্ষ টাকাও তালগাছ লাগানোর পেছনে খরচ করেন। তিনি নিজ হাতে যত্নসহকারে গাছ লাগান এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্য করেন।

ঢাকায় ঢাকায় ১৬ হাজার তাল গাছ লাগিয়েছে এসইএল চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক ইবনুল সাঈদ রানা। জানাগেছে, ২০১৪ সালের ইবনুল সাঈদ রানা চাঁদপুর এসইএল মডেল একাডেমীর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে পাঁচ শত তালের আঁটি সংগ্রহ করেন। সেই পাঁচশ তালের বিচি ঢাকায় হাতিরঝিল, ধানমন্ডি লেক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে রোপণ শুরু করেন। এসইএল চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক ইবনুল সাঈদ রানা বলেন, কেউ তালের বিচি রোপণ করতে চাইলে তালের বিচি গ্রাম থেকে বিনামূল্যে সংগ্রহ করা যায়। তিনি এই বছর জুলাইয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে ৫০ হাজার তালের বিচি রোপণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।’

Palm tree Dhaka

আরো একটি খবর জেনে তোমরাও হয়তো তালগাছ লাগাতে উদ্ধুদ্ধ হবে। তালগাছের সুদিন ফিরিয়ে আনতে যশোরের কয়েক যুবক ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ নিয়েছে। যার নেতৃত্বে রয়েছেন জেলার মনিরামপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের হাসাডাঙা গ্রামের উদ্যমী যুবক নাঈম রেজা। এই যুবক পৃথিবীর বৃহত্তম তালের সারি গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রায় ৪০ কিলোমিটার সড়কের ধারে তালের আঁটি রোপণ করেছেন। জানাগেছে ২০১৪ সালের প্রথম মনিরামপুর উপজেলার চিনেটোলা বাজার এলাকার ফকিরের রাস্তা থেকে রাজগঞ্জ পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশে ছয় হাজারের বেশি তালের আঁটি রোপণের মাধ্যমে এই যাত্রা শুরু করেন। ২০১৫ সালে নিজ গ্রাম হাসাডাঙা থেকে কেশবপুরের মধ্যকুল এলাকা পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রাস্তার পাশে ছয় হাজার তালের আঁটি রোপণ করেন। ২০১৬ যশোর-রাজগঞ্জ-সাতক্ষীরা ৭৫ কিলোমিটার সড়কের দুপাশে ১২ কিলোমিটারের বেশি অংশে ছয় হাজার তালের আঁটি লাগানো সম্পন্ন হয়েছে। রাস্তার বাকি অংশে লাগানোর কাজও অব্যাহত আছে।

তালগাছ প্রেমী নাঈম রেজার সহযোগিতায় আছেন তার বন্ধু সরোয়ার হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, আশিকুর রহমান, সোহেল রানা। জানাগেছে, এই যুবকেরা রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের দুপাশে গহের আলীর তাল গাছের সারির ওপর প্রতিবেদন দেখে উদ্বুদ্ধ হয়। নওগাঁ জেলার ভিমপুর ইউনিয়নের শিকারপুর গ্রামের শতোর্ধ্ব বয়সী বৃদ্ধ গহের আলীর তালগাছ লাগানোর খবর ৩০ জানুয়ারি ২০০৯ জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে দেশবাসী জানতে পারে। ভিক্ষুক বৃদ্ধ গহের আলীর চাল-ডাল আর তালের আঁটি ভিক্ষে হিসেবে সংগ্রহ করে আঁটি পুঁতে দেন সরকারি রাস্তার দুই পাশে। প্রখর রোদে পথচারীদের কষ্টের কথা চিন্তা করে গহের আলীর তালগাছ লাগানোর কাজ শুরু করেন তিনি। রাজশাহী নওগাঁ মহাসড়কের ভিমপুর ইউনিয়নের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে যে তালগাছগুলো তার সবই গহের আলীর লাগানো। ইত্যাদিতে প্রচারের পর সেই বছরেরই ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে প্রথমবারের মতো জাতীয় পরিবেশ পদক-২০০৯ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ গ্রহণ করেন। ২৭ ডিসেম্বর ২০১০ সালে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মানুষ ইচ্ছা করলে সমাজ ও দেশকে কতভাবেই না কতকিছু দিতে পারে। গহের আলী, ইরোজ স্যার এবং নাঈম রেজার মতো হয়তো আরো অনেকেই নিভৃতে এমন সামাজিক কাজ করে চলেছেন। জলবায়ুর পরিবর্তনে আবহাওয়ার বিপর্যয়ে প্রকৃতির নির্দয় প্রতিশোধ বজ্রপাত থেকে জানমালের রক্ষা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় চলো আমরা সবাই সাধ্যমত নিজ দায়িত্বে তালগাছ লাগাই।

জীবনযাপন থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

S M Mukul
এস এম মুকুল
লেখক-কলামিস্ট, হাওর ও কৃষি অর্থনীতি বিশ্লেষক

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *