প্রথম পাতা » মতামত » হুমায়ূন আহমেদের ‘শিক্ষক’ চরিত্র ও সমকালীন বাস্তবতা

হুমায়ূন আহমেদের ‘শিক্ষক’ চরিত্র ও সমকালীন বাস্তবতা

Humayun Ahmed Teaching

সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সাহিত্যিক সমাজেরই মানুষ। একজন ভালো মানের সাহিত্যিক সমাজ সেচে তুলে আনেন সমকালীন জীবন ও বাস্তবতা। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, নির্মাণের মহান কারিগর, গল্পের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর নাটক, সিনেমা, গল্প, উপন্যাসে আছে অসংখ্য শিক্ষকের চরিত্র। তাঁর সৃষ্টি থেকে কয়েকজন শিক্ষক চরিত্রের কথা এখানে তুলে ধরব। আমাদের সমাজের চোখে শিক্ষকদের অবস্থান কিছুটা হলেও বুঝতে পারা যাবে।

হুমায়ূন নিজে শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতার সিরিয়াস দিকটাও তিনি জানতেন। এসব চিত্রও কিছু আছে তাঁর সৃষ্টিতে। তাঁর সৃষ্ট মিসির আলীও একজন শিক্ষক। মিসির আলী কাজ করে লজিক নিয়ে। মিসির আলীর সামনে মাঝে মাঝে এন্টি লজিক নিয়ে হাজির হয়েছে হিমু। তবে বাংলাদেশের সমস্ত শিক্ষককুলের পক্ষে মিসির আলী হওয়া সম্ভব নয়। মিসির আলী রাজনীতি করেন না। আমাদের শিক্ষকদের রাজনীতি করতে হয়। মিসির আলী দল করেন না। আমাদের শিক্ষকগণ নীল ও সাদায় বিভক্ত। সবচেয়ে বড় যে কাজ তা হলো একজন যোগ্য শিক্ষকের পেছনে কতগুলো অযোগ্য, অথর্ব শিক্ষকের লেগে থাকা, হেনস্তা করা, পদোন্নতি বঞ্চনা, অপমান করার জন্য! তারচেয়েও বড় কথা মিসির আলীর স্কুল কলেজে বাংলাদেশের মতো মহামতি ম্যানেজিং কমিটি নেই! শিক্ষকতার মজা ঐ ব্যাটা বুঝবে কী?

হুমায়ূন আহমেদ শিক্ষকতা পেশা থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। ‘পড়াতে ভালো লাগে না’ এমন অজুহাত তিনি দেখিয়েছেন। তবে শিক্ষকতা জীবনের কিছু রূঢ় বাস্তব অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। ‘দেয়াল’ উপন্যাসে এর কিছুটা বর্ণনা পাওয়া যায়।

‘হাবলঙ্গের বাজার’ নাটকে একজন শিক্ষকের চরিত্র আছে। সে ‘বেশি কথা বলে’! বিএবিএড গোল্ড মেডেলিস্ট এই শিক্ষক সুযোগ পেলেই তাঁর ‘অদম্য’ সাহসিকতার গল্প করেন। একদিন এক বদমেজাজী দারোগাকে ধমক দেওয়া এবং দারোগার হাতের লাঠি মাটিতে পড়ে যাওয়ার সেই ঐতিহাসিক ঘটনা তিনি বলে বেড়ান গভীর বিস্ময়ে। এই শিক্ষককে ‘মুক্তিযোদ্ধা’র বেশে অভিনেতা ফারুক দুনলা বন্দুক দিয়ে যে দাবুড় দিয়েছে তা দেখে বাংলার মানুষ হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে!

তাঁর প্রায় নাটকেই হেড মাস্টারের চরিত্র থাকে। একসময় আবুল খায়ের ও সালেহ আহমেদ চরিত্রগুলোয় দুর্দান্ত অভিনয় করতেন। হেড মাস্টাররা প্রায়ই ঐ নাটকের নিয়ন্ত্রক চরিত্রটির পোষ্য হয়েই থাকে! হেড মাস্টারের স্বকীয়তা তেমন নেই বললেই চলে।

তাঁর গল্পে আছে অনেক ‘ফানি ম্যান’ টাইপ শিক্ষক চরিত্র। সমাজের সবচেয়ে হালকা লোক হিসেবে এরা গল্পে উপস্থিত। ‘ফজলুল করিম সাহেবের ত্রাণকার্য’ গল্পে শিক্ষক সম্প্রদায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করতে রিলিফ হিসেবে নিয়ে যায় খাতা-কলম-পেনসিল! উত্তেজিত জনতা তাদের ধোলাই দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে!

তাঁর ‘অচিনবৃক্ষ’ গল্পে আছে জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন স্কুল মাস্টারের কাহিনি। টাকার জন্য স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এখন তিনি ভরসা করে আছেন মিরাকলে। একদিন অচিন বৃক্ষের ফুল ফুটবে, সেই ফুলই সুস্থ করবে তাঁর স্ত্রীকে। গাছ থেকে পঁচা শেওলার গন্ধ বের হচ্ছে। ফুল ফোটার সময় এসে গেছে। আর কেউ সে গন্ধ পায় না কেবল মাস্টার সাহেব পান!

ওপরে হতদরিদ্র, ফানি ম্যান, সমাজের সবচেয়ে তলানিতে বাস করা শিক্ষক সম্প্রদায় আজ বাংলার আনাচে কানাচে। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করতে পারে যদি একটি বিশেষ গোষ্ঠী তাহলে অন্য পেশার মানুষের প্রয়োজন কী এই সমাজে! স্মরণকালের বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের পেয়েছেন? রাজনীতিকদের পেয়েছেন? তাহলে ওরা কারা? বঙ্গবন্ধুর এই দেশ তো সাধারণ মানুষের, সব মানুষের। তাঁর সময়ে শিক্ষকদের মর্যাদা কোথায় ছিল জানেন? তিনি শিক্ষকদের ধরে এনে মন্ত্রীসভায় ঠাঁই দিতেন! সে দিন আজ সুদূরে পরাহত!

সেদিন নড়াইলের মির্জাপুরে একজন বিধর্মীকে জুতোর মালা পরানো হয়নি, একজন শিক্ষকের ত্রিশ বছরের সব অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে সেখানকার উচ্ছৃংখল ছাত্র জনতা! অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস আজ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন! এই লজ্জা রাখি কোথায়? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর কন্যার শাসনামলে এর চেয়ে দুঃখের ঘটনা আর কী হতে পারে!

গফরগাঁও সরকারি কলেজে তাণ্ডব চালালো একদল দুর্বৃত্ত! শিক্ষকদের মারল, অবরুদ্ধ করে রাখল অথচ পুলিশ মামলা নিল না, এমপি মহোদয় কোনো পদক্ষেপ নিলেন না! উল্টো ধমকি ধামকি খেয়ে বিষণ্ন মনে কাজ করছেন গফরগাঁওয়ের নিপীড়িত শিক্ষক-কর্মকর্তারা। দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি একটা মন্তব্য পর্যন্ত করলেন না। সারাদেশে কর্মবিরতি হলো। জায়েদ-মৌসুমি-ওমরসানির খবরের নিচে চাপা পড়লো শিক্ষা ক্যাডারের অসন্তোষ, আর্তনাদ।

একটা দেশ কতটা বর্বর হলে একজন ছাত্র তার শিক্ষককে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করতে পারে! আহা! জীবন! বাংলাদেশে একজন শিক্ষকের নিরাপত্তা পথের নেড়ি কুত্তার চেয়েও নাজুক!

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক দখলদারি, নিপীড়নের বিরুদ্ধে একাই অনশন প্রতিবাদ করছেন! গোবেচারা টাইপ, গবেষক- প্রাবন্ধিক অজয় বসাক নামের একজন এমেরিটাস অধ্যাপকের বাড়ি জবর দখল করে রেখেছে একজন দুর্বৃত্ত। কোথাও তিনি প্রতিকার পাননি, দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন! তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুশো। কী বোকা এই লোকটা! এদেশে বই পড়ে কে? দুশো বই লিখে সময়ের অপচয় না করে একটি পোলা পয়দা করে পুলিশে বা আর্মিতে দিতেন! চৌদ্দ গোষ্ঠী বেহেশতি সুখ লাভ করতেন! এই দেশের লোক ডাণ্ডাতেই ঠাণ্ডা!

রাষ্ট্রের মনে রাখতে হবে এদেশে আনিসুজ্জামান একাই শিক্ষক নন। আমরা লালগালিচা চাই না। আমরা নির্বিঘ্নে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে চাই। আমরা বুকের ভিতর আগুন নিয়ে সোনার বাংলার স্বপ্ন ফলিয়ে যাই। আমাদের নিরাপত্তা দিন, কর্মক্ষেত্রে আমাদের কর্মপরিবেশ গড়তে দিন। আমরাই নির্মাণ করব বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। একজন শিক্ষকের একটা লেকচারের মূল্য জাতি কোনোদিন শোধ করতে পারবে না। বাংলাদেশের শিক্ষকরা স্বাধীনতার বেদীমূলে জীবন উৎসর্গকারী শহিদ মুনীর চৌধুরীর উত্তরসুরি, আনোয়ার পাশাদের উত্তরপ্রজন্ম। এদের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা ছাড়া কোনো প্লানই বাস্তবায়ন হবে না জেনে রাখুন।

এ সমাজ শিক্ষক চায় না। রাষ্ট্রও হয়তো চায় না। যদি চাইতো তবে হুমায়ূন আহমেদ শিক্ষকদের এতোগুলো কমিক চরিত্র বানাতে পারতেন না। হুমায়ূনের শিক্ষক সম্প্রদায়ের হাসির আড়ালে কান্না লুকিয়ে আছে। এরা মুখ বুজে মুক্তার চাষ করে কিন্তু ভিতরে বিষের বালি!

আজ মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসে না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা স্বপেশায় আসতে অনীহা প্রকাশ করে। তাহলে এদেশ গড়ে তুলবে কারা?

বঞ্চিতের অভিশাপের চেয়ে বৃহৎ অস্ত্র আর এই পৃথিবীতে নেই!

মতামত থেকে আরও পড়ুন

লেখক পরিচিতি:

Sujon Hamid
সুজন হামিদ
জন্ম: ২৯ মার্চ, ১৯৮৭ খ্রি., শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম তাওয়াকুচায়। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পারিবারিক জীবনে তিন পুত্র আরিয়ান হামিদ বর্ণ, আদনান হামিদ বর্ষ এবং আহনাফ হামিদ পূর্ণকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। একসময় থিয়েটারে যুক্ত থেকেছেন। রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন অনেক পথনাটকে। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে লালন করেন হৃদয়ে। স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের। গ্রন্থ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানগ্রন্থ 'বাংলাকোষ'(২০২১)।

ইতল বিতলে আপনার লেখা আছে?আজই লিখুন



আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *