এক চরম সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডলে আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে। আমার গোষ্ঠীতে যেহেতু আমিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের গোসলখানায় স্নান করে স্নাতক, আর বাকিরা সবাই নদী কিংবা বড় পুকুরে স্নান করলেও স্নাতক হতে পারেনি সেহেতু নজরুল, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পরিবার থেকে কিছু জানার সুযোগ আমার হয়নি। তাঁরা এতদবিষয়ে সত্য-মিথ্যা কোনো গল্পও বলতে পারেননি। গল্পগুলো আমি শুনেছি পাড়ার আড্ডায়, স্কুলের বন্ধুমহলে কিংবা মুরুব্বিদের বৈঠকি গালগল্পে।
নজরুল নাকি আক্ষেপ করে বলেছিলেন- পূর্বে যদি না উঠিত রবি / আমি হতাম বিশ্বকবি। পরে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স এবং এম.ফিল করেও এমন কোনো পঙক্তি খোঁজে পেলাম না! যদি থাকে কেউ জানলে জানাবেন। বিশ্বকবি হওয়ার কোনো মোহ সম্ভবত নজরুলের ছিল না। বিপ্লবী কখনো বিদ্রোহের মোহের বাইরে যায় না। বিশ্বকবি হলে বিপ্লব করা যায় না- এই সত্যটি মনে হয় নজরুল অনুভব করেছিলেন। তিনি রইলেন পরম বিরহী ও চরম বিদ্রোহী ‘বেয়াদব’ কবি হয়েই! বাঙালির নতুন চণ্ডীদাস, আমাদের চারণ কবি কাজী নজরুল ‘ইসলামবিদ্বেষী’ (?) এই মানুষটা মাত্র আধা ঘণ্টায় লিখলেন “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ইদ”, লিখলেন নবি স. কে নিয়ে অনেক জনপ্রিয় গান, গজল লিখলেন, শ্যামাসঙ্গীতও লিখলেন। আর নিন্দুকেরা বলল- নজরুল তুমি করিয়য়াছ ভুল / দাড়ি না রেখে রাখিয়াছ চুল!
“নোবেল কমিটি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে ডাকলেন নোবেল দিবেন বলে। একটা তারিখ ঠিক হলো। রবীন্দ্রনাথ জানেন নোবেল তিনি না, পেতে যাচ্ছেন নজরুল! এখন উপায়? তিনি মালু! কূটবুদ্ধি অনেক। নজরুলের সুইডেন যাওয়ার রাস্তায় এক বুড়িকে বসিয়ে রাখলেন। নজরুল রওয়ানা হলেন। পথে অসুস্থ বুড়িকে পেয়ে নোবেলের নিকুচি করলেন। বুড়ির সেবা করতে লাগলেন দয়াময় মুসলিম কবি! ওদিকে রবীন্দ্রনাথ বিনা বাধায় সুইডেন গেলেন। পথের কাঁটা পরিষ্কার। বাংলা সাহিত্যের নোবেল গেলো এক মালাউন বুইড়ার ঘরে!” গল্প বিশ্বাস করেছি, ইমান এনেছি।
পরে জানলাম ১৯১৩ সালে নজরুল পোলাপান, কাজ করেন রুটির দোকানে। পড়েন ক্লাস নাইনে বা টেনে! এরচেয়ে সাম্প্রদায়িক গল্প একজন শিশুর কাছে আর কী হতে পারে! এমন অনেক গল্পই বঙ্গালমুলুকে ভেসে বেড়াত। হয়তো আজো ভাসে। নজরুলকে নিয়ে বলতেন সনাতনীরা, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বলতেন মুসলমানেরা। বাংলা সাহিত্য দাঁড়িপাল্লায় উঠেছে বহুকাল আগে থেকেই। রবীন্দ্র-নজরুল আজো সেই দাঁড়িপাল্লা থেকে নামতে পারেননি। অথচ দুইজন দুইজনকে বই উৎসর্গ করেছেন। খোঁজ নিয়েছেন একে অপরের। নিজেরা কখনো কে বড় কে ছোট সেই তর্কে জড়ান নি। নজরুল যখন জেলে অনশন করছেন রবীন্দ্রনাথ তখন অনশন ভাঙার তাগিদ দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্য যে নজরুলকে অনুভব করছে সে কথা চিঠিতে জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নজরুলকে তিনি ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করলেন, নজরুলও বিনিময়ে তাঁর ‘সঞ্চিতা’ কাব্য উৎসর্গ করলেন গুরুদেবকে। তবু রবীন্দ্রনাথ থামলেন না! “নিজের এক আত্মীয়কে বিয়ে দিয়ে নজরুলকে পাগল বানিয়ে রাখলেন! কেন? আরেকটি নোবেলের আশায়!” আহারে বাঙালি! কতো হারামি!!!
নজরুল, রবীন্দ্রনাথ দুইজন দুই পথে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। এক জনের সাথে আরেকজনের তুলনা চলে না। রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলসঙ্গীত যেমন শুনলেই বুঝা যায় কোনটি কার তেমনি দুজনেরই আছে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত শিল্পিতসৌরভ। অনুভূতির হৃদয় দিয়ে সে ঘ্রাণ নিতে হয়।
বাংলা সাহিত্যের শান্ত সমুদ্রের নাম রবীন্দ্রনাথ, সেই সমুদ্রের উন্মাতাল ঢেউয়ের নাম কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুলের জন্মদিনে “রবীন্দ্র-নজরুল বিষয়ক তর্কালাপ বন্ধ হোক” এই আমার কামনা।