আজরফ আলী হাঁটতে থাকে। গা ছমছম করা নিশুতি রাতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার সম্মিলিত ডাককে মনে হয় সহস্র হাতির গর্জন। টর্চের আলোও কেমন ঝিমিয়ে পড়ছে। ব্যাটারি শেষ কি না কে জানে? আরো অনেকটা পথ তাকে যেতে হবে। সামনেই নদী। নদীতে এখন পানি কম। বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া উপায় থাকে না। নদীও তখন প্রশস্ত হয়। বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি নেওয়ার কোনো উপায় নেই। কেউ মরলেও না। তিন কিলো হেঁটে তবেই গাড়ির বন্দোবস্ত। আজরফ আলী সেন্ডেল খুলে হাতে নেয়। আজ হাটবার ছিল না বলে তার সঙ্গী জোটে নি। পানিতে পায়ের ছপছপ শব্দ কানে বাজে তার। নদীর কোথাও কোথাও চর পড়েছে। কোথাও গভীর খাদ। নদীতে মেশিন লাগিয়ে বালু তোলা হয় এখন। পাহাড়ে মানুষের খাবার নাই আর। এখন নদীর তলদেশের বালু খায় মানুষ। বালু শেষ হলে মানুষ কি আসমানে হানা দিবে? আজরফ এর কূলকিনারা পায় না।
একটু দূরে একটি বিড়ির আগুন উঠানামা করছে। কেউ হয়তো মাছ ধরছে জাল পেতে। একসময় নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। আজরফের মনে পড়ে জোছনা রাতে নদীতে মাছ ধরার কথা। দলবেঁধে মাছধরতো তারা। সারারাত মাছ ধরে ভোরবেলায় গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে ফিরতো নিজগাঁয়ে। আজ সেই যৌবনও নেই,মাছও নেই। বয়স কতো হলো তার? কতই আর হবে? সংগ্রামের সময় বার কি তের!
নদী পার হয়ে আজরফ হাঁটতে থাকে গ্রামের দিকে। পাহাড়ঘেঁষে এই রাস্তা চলে গেছে বর্ডার পর্যন্ত। থেকে থেকে ঠান্ডা বাতাস আসছে পূবদিক থেকে। কোথাও হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে। এই রাস্তাটায় হাতির ভয় আছে। মাঝে মাঝেই উত্তরের বর্ডার ক্রস করে নেমে আসে শত শত হাতির পাল। এরা লোকালয়ে আসে। ফসল খায়,নষ্ট করে। মানুষের বাড়িতেও হানা দেয় এরা। কলাগাছ এদের প্রিয় খাদ্য। গ্রামে কারো বাড়িতে আর কলাগাছ নেই। সবাই বড়ইগাছ লাগিয়েছে। বড়ইকাঁটা হাতির যম।
আজরফের মনে পড়ে গতবছরের কথা। আষাঢ় মাসের পয়লা। আজরফ গেছে হাটে। সবজি বিক্রি করে বাজার সেরে ফিরতে সেদিন একটু রাতই হয়েছিল। কয়টা হবে? নয়টা কি দশটা? পুরো গ্রাম শুয়ে পড়েছে। কোথাও বাতি নেই। আজরফ দুই ব্যাটারির টর্চটা নিয়ে বাড়ির দেউরি পর্যন্ত গেলো। কলপাড়ে পা ধুতে যেতেই থমকে দাঁড়ালো সে। কী দেখছে সে? বড় ঘরের সামনে ওটা কী? এখন সে কী করবে? ছুটে পালাবে? নাকি চিৎকার করবে? বাড়িতে যারা আছে তাদের কী হবে? হয়তো কিছুই হবে না। সে এসেছে একা। কিছুই না পেয়ে চলে যাবে। আজরফ ঘামতে শুরু করলো। কলের হাতল ধরে ঝিমমেরে বসে পড়লো। একি? দরজা খোলার শব্দ মনে হচ্ছে! কে বাইরে আসে? আজরফ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে- না, বাইরে আইসো না, বাইরে হাতি!!! কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দই বেরোলো না। ঘরের বাতি জ্বললো। জহিরের মা, তার বিবি বের হচ্ছে!
বিশাল দেহটি নিয়ে সে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো নিমিষেই ঝাঁপিয়ে পড়লো। দরজাটি মড়মড় শব্দে ভেঙে গেলো। শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো জহিরের মাকে। মনে হলো একটা সাদা রঙের গোল বল ওপরে উঠছে নামছে। জহিরের মা কোনো শব্দ করার সুযোগ পায় নি। মাটির ঘরের দেয়ালে পরপর তিনটি আছাড়। তারপর তাণ্ডব। কতক্ষণ? অচেতন আজরফ মনে রাখবে কীভাবে?
জহিরের মাকে যারা গোসল দিয়েছিল তারা বলেছে শরীরে কোনো হাড় ছিল না। কেবল একটি মাংসপিন্ড। জহির, তার বৌ আর দুই মেয়ে সেদিন বেঁচে গিয়েছিল শ্বশুরবাড়ি থাকায়।
কলপাড়ে পা ধুতে এসে কলের হাতলটি ধরে সে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কলের শব্দ শুনে জহিরের বৌ বেড়িয়ে আসে। ‘বাবা আইছেন।’ ‘হ’।
জহিরের মেয়ে দুটি ঘুমিয়ে পড়েছে। জহির গেছে খেতের ধান পাহারা দিতে। পালা করে ওরা পাকাধান পাহারা দেয়। কখন হাতি আসে ঠিক নেই। কারেন্টের বাতিও ওরা আর ভয় পায় না এখন। ধানকাটা হয়ে গেলেই বিপদ শেষ।
‘কেমন দেইখা আসলেন জোহরারে?’ মৃত সন্তান প্রশব করা জোহরা আজরফের ছোট মেয়ে। সদর হাসপাতালে ভর্তি এখন। মেয়েকে দেখেই ফিরলো আজরফ।
‘আছে একরকম। হাসপাতালে মানুষ যায়! আল্লা শত্রুরেও যেন হাসপাতালে না নেয়।’ আজরফ খাওয়া শেষ করে ঘুমোতে যায়। নাতনিদের জন্য আনা কয়েকটি চকলেট বৌয়ের হাতে দিয়ে সে চলে যায় পশ্চিমের ঘরে। হাতির তাণ্ডবের পর টিন দিয়ে এ ঘরটি নতুন করে বানানো হলো। দুটি জানালা এখনো খোলা। বাইরে থেকে সবই চোখে পড়ে। দরজাটা শুধু লাগানো হয়েছে। ছয়মাস হলো বাড়িতে কারেন্ট এসেছে। তীব্র আলোর দিকে তাকিয়ে আজরফের মনে পড়ে সেই অন্ধকার রাতের কথা! ভ্যাঁপসা গরমে ফ্যানের সুইচটা অন করে শুয়ে পড়ে আজরফ। বাড়িতে কারেন্ট থাকলে হয়তো জহিরের মায়ের এমন নির্মম মৃত্যু হতো না সেদিন!
গ্রামের চায়ের দোকানে সবাই বলাবলি করে দেশে কী একটা ভাইরাস এসেছে। নাক মুখ চোখ দিয়ে গলায় ঢুকে। তারপর কলিজা খেয়ে ফেলে। জহির বিল্লালের মোবাইলেও দেখেছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মরছে। পাশের বাড়ির নজরুল ঢাকায় গার্মেন্টসের চাকরি করতো। সেও মাস খানেক হলো বাড়িতে। কীসের নাকি লকডাউন চলছে। আজরফও সদরে দেখে এলো সবাই মুখে কী জানি পড়েছে,গরুর টোপার মতো। সে পড়েনি বলে কে একজন তাকে ধমক দিয়েছে। রোগটা নাকি ছোঁয়াচে। কিসলু চাচার চায়ের দোকানে দুনিয়ার রাজনীতি। সকল বিষয়ের সমাধান আছে চায়ের কেটলিতে। সবাই একবাক্যে স্বীকার করে এইসব ভাইরাস টাইরাস কিছু না। আল্লা বেইমান শায়েস্তা করতাছে। বিল্লাল সৌদি আরবের কথা কী একটা বলছিল। গতবছর হালখাতা করে নাই বইলা কিসলু চাচা মারতে গেলো। জহির হাতধুয়ার কথা বলে সেদিন ধমক খেলো। কিসলু চাচার মুখের নাই বেড়া। ‘ হ যাও,বাড়িত গিয়া সাবান লাগাও। পুটকি ধোও আর না ধোও, হাত ধুইবা তিনবেলা।’
‘বাজান ধান কাটা লাগে। কবে কাটবা?’ আজরফ মাথা নাড়ে। হ কাটা লাগবো তাড়াতাড়ি। সেদিন আজরফ সারাদিন শুয়ে থাকলো। শরীরটা কেমন গরম। সারাদিন কিছুই খেলো না। জহিরের মুখ কালো হয়ে গেলো।
পরদিন তিন কিলো দূরে বাজার থেকে ফার্মেসির ডাক্তার নবারণ কে আনলো জহির। নবারণ আজরফের কাছে গেলো না। দূর থেকে দেখেই ওষুধ দিলো আর বলে গেলো অবস্থা ভালো না হাসপাতালে নেও তারে। তারে আলাদা রাখতে হবে। কেউ কাছে গেলে মহাবিপদ!
আজরফ হাসপাতালে যাবে না বলে দিলো। মরলেও না। থালা বাটি বাসন আলাদা করে আজরফকে পশ্চিমের ঘরে রাখা হলো। জহির বলে দিলো খবরদার কেউ যেন কাছে না যায়। মেয়ে দুটি কাঁদে কেন? বড়মেয়েটা বলছে- দাদারে বন্দি করলা কেন বাজান?
বিকেলের দিকে আজরফের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। পড়শিরা দুই একজন আসে। দূর থেকে দেখে চলে যায়। বিষধর সাপকে বেঁধে রাখা হয়েছ এমন। কিসলু চাচাও এলো- ধূর কিছু না। সিজনাল। তুলসীপাতা বাইটা খাওয়ায়ে দে। ঠিক হইয়া যাইবো। আর কতখানি হওড়ার তেলে…
কামারের দোকানের হাঁপড়ের মতো উঠানামা করে আজরফের বুক। একবার নিশ্বাস নেওয়া যেন কতোকালের জমানো পাথর সরানো! বুকে যেন আস্ত একটা হাতি বসে আছে। নড়েচড়ে না। সন্ধ্যারাতে ঝড় হলো কিছুক্ষণ। কেউ এলো না। বিদ্যুৎ নেই। আকাশে কালো মেঘ। রাত তখন দশটা হয়তো। আজরফ গোঙাচ্ছে। প্রচণ্ড গোঙানির শব্দে জহির আর তার বৌ বাইরে এলো। টর্চের আলোয় দেখলো মানুষটা কেমন করছে। ছটফট করছে। মুখ দিয়ে ফেনা পড়ছে নাকি? কাটা মুরগির মতো ছটফটানি তার। পানি পানি বলে চেঁচাচ্ছে। দরজাটা ভেঙে ফেলবে নাকি? তালা মারা যে সে কি বুঝে না? এবার সে উঠতে চায়। কোরবানির গরুকে শোয়ানোর পর,জবেহের ঠিক আগে সর্বশক্তি দিয়ে যেমন উঠতে চায় তেমন করে উঠতে চায় সে। পারে না। কেবল গোঙায় আর পানি চায়। এবার যেন জবাই হয়েছে লোকটা ষাঁড়ের মতো। পা দুটি ঝাড়ছে,বিশালদেহী ষাঁড়টার মতো শেষ চেষ্টা করছে। একবার উঠতে চায় সে।
‘বাজানগো’ বলে জহির ডুকরে কেঁদে ওঠে। এবার আজরফ শরীরের সব কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। লুঙ্গিটাও ফেলে দেয় উন্মাদের মতো। জহিরের বৌ কেঁদে ওঠে। ‘ আল্লা তারে তুমি নিয়া যাও। শান্তি দেও তারে!’
‘মানুষটারে পানি দ্যান,পানি দ্যান!’ ‘ একজনের জন্য কয়জনরে মারবি? হের আশা ছাইড়া দে ময়নার মা। আল্লা তুমি বাজানরে শান্তিতে মরবার দেও!’
আজরফ এবার মেঝেতে গড়াগড়ি করে। আর কোনো শব্দ নাই লোকটার। পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা বিশাল পাথরখণ্ডের মতো কেবলই গড়াগড়ি করে। মুখ দিয়ে ফেনা পড়ে।
– ‘ঘরের চাবি কই রাখছেন কন?’
– ‘খবরদার বৌ,তোর দুইডা মাইয়া আছে!’
– ‘আপনে চাবি দ্যান’
– ‘চুপকর বৌ’
জহিরের বৌ দৌঁড়ে ঘরে যায়। চাবি সে পেয়েছে। সে তার নাক মুখ বেঁধে একগ্লাস পানি নিয়ে রওয়ানা দেয় পশ্চিমের ঘরের দিকে।
মেঘ কেটে গেছে। চারদিকে ফুটফুটে জোছনা। তালা খুলতে তার একটুও বেগ পেতে হবে না আর!